- ইজারা বাতিল
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার নদীতে ইজারা বাতিল করেছে জেলা প্রশাসন। গত বৃহস্পতিবার রাজারহাট উপজেলা নির্বাহি অফিসার (ইউএনও) নুরে তাসনিম ইজারা বাতিল সংক্রান্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি অবহিতকরণ চিঠি প্রাপ্তির তথ্য আনন্দবাজারকে নিশ্চিত করেন।
জানা যায়, কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া এ নদী উজানে চাকিরপশার এবং ভাটিতে মরা তিস্তা ও বুড়ি তিস্তা নামে পরিচিত।
রাজারহাট উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৪০ সালের রেকর্ড অনুযায়ী চাকিরপশার নদীর মোট জায়গা ছিল ৩০৬ একর। নদীতে ভাটা পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় দখলদাররা নদীর বিভিন্ন অংশে পাড় বেঁধে পুকুর, রাস্তা ও ফসলি জমি বানিয়ে দখল করায় বর্তমানে নদীর মোট জমি রয়েছে ১৪১ একর। আশির দশকে রাজারহাটের পাঠান হাটে আড়াআড়িভাবে সেতুবিহীন সড়ক নির্মাণ করায় নদীর প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয়। এ সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীতে বাঁধ দিয়ে অর্ধশত পুকুর বানিয়ে ও আবাদি জমি তৈরি করে ভোগ দখল করা শুরু করে। এতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার একর কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তিন ফসলি জমি হয়ে ওঠে এক ফসলিতে। কোনো কোনো বছর এসব জমিতে একবারও ফসল পাওয়া যায় না। বেদখল হওয়ায় নদীর মোট জায়গার পরিমাণ ৩০৬ একর থেকে ১৪১ একরে নেমে আসে।
এমতাবস্থায় নদীটিকে ‘বদ্ধ বিল’ দেখিয়ে ইজারা দেওয়া শুরু হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ৪ মার্চ জেলা জলমহাল কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ি চাকিরপশার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে একটি অমৎস্যজীবি সংগঠনকে তিন বছরের জন্য (বাংলা ১৪২৭ থেকে ১৪২৯ সন পর্যন্ত) নদীর ১৪১ একর ইজারা দেওয়া হয়।
এ পরিস্থিতিতে চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি, রিভারাইন পিপল ও গণকমিটি যৌথভাবে চাকিরপশার নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ, জলাবদ্ধতা নিরসন, জেলে ও সাধারণ মানুষের জন্য উম্মুক্তকরণ, খনন, ইজারা বাতিল এবং সেতুবিহীন সড়কে সেতু নির্মাণের দাবীতে কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে। আন্দোলনের মুখে গত বছরের ২ ও ৩ নভেম্বর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ৫ সদস্যের একটি জরিপ টিম সরেজমিনে পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শনকালে জরিপ টিমের আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত সচিব ড. মতলুবর রহমান বলেন, নদীকে সংকুচিত করার সুযোগ নেই। নদী কমিশন চায়, নদী তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রবাহমান হবে। কোনো দখলদার নদীর গতিপথ বন্ধ করতে পারবে না। তদন্ত শেষে কমিশন চাকিরপশার অবৈধ দখল উচ্ছেদ, সেতুবিহীন সড়কে সেতু স্থাপন, স্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিলসহ রাজারহাটের ইটাকুড়ি হতে তিস্তার মিলনস্থল পর্যন্ত চাকিরপশার নদীর স্রোত বাঁধাহীন করার সুপারিশ করেন।
জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের ৯ মার্চ চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির সদস্য সচিব তারেক আহমেদ জেলা প্রশাসক, কুড়িগ্রাম বরাবর চাকিরপশার নদীর ইজারা অমৎস্যজীবিদের নিকট প্রদান করা হয়েছে মর্মে ইজারা বাতিলসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজারহাট উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মৎস্য বিভাগের সহযোগীতায় কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে, চাকিরপশার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লি. এর নিবন্ধন যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি। তাছাড়া ওই সমিতির ২০ জন সদস্যের মধ্যে একজনও প্রকৃত মৎস্যজীবি নন। তাই সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর ২(খ) ধারা অনুযায়ী চাকিরপশার মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লি. এর লিজ পাওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে অভিযুক্ত সমিতির লিজ বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে চাকিরপশার নদীর লিজ বাতিলের খবর জানাজানি হলে আন্দোলনকারী ও নদী পাড়ের মানুষজন আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েন। তারা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রেজাউল করিম কে ধন্যবাদ জানান এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, হাজার হাজার জেলে চাকিরপশার নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে, ইজারা দেওয়ায় এসব মৎস্যজীবি নদীতে নামতেও পারতেন না। এখন চাকিরপশার নদীতে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। অবিলম্বে দখলদারদের উচ্ছেদের আহ্বান জানান তিনি।
গণকমিটির নেতা ও চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ আনন্দবাজারকে বলেন, অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে চাকিরপশার নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মসূচী পালন করতে হয়েছে। দখলদারদের প্রভাবে সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপুর্ণভাবে কর্মসূচী পালনে অসংখ্যবার কর্মসূচীর স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। তারপরও থেমে যাইনি। ভীতও হইনি। আন্দোলন চালিয়ে গেছি। সংগঠিত জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা। তাই সফলতা এসেছে। প্রথম ধাপে লিজ বাতিল হয়েছে। এখন দ্রুত চাকিরপশার নদী দখলমুক্ত করার দাবী জানান তিনি।