পূর্ব আকাশে রক্তিম আভা ছাড়িয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবী সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে। পাখির কিচিরমিচির ডাকে মূখরিত চারদিক। এমন এক স্বর্গীয় পরিবেশে বাড়ির আঙিনায় ধুপধাপ শব্দ। কিছুক্ষণ পরেই মেয়েলি কন্ঠে ভেসে উঠে- ‘ধান ভাঙ্গিরে ঢেঁকিতে পার দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া – দুলিয়া ও ধান ভাঙ্গিরে’ অথবা ‘ও বউ দান ভানি রে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে, হেলিয়া দুলিয়া ও বউ ধান ভানে রে’
আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে প্রায় সব জায়গায়। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান পাল্টেছে। মাটির বাড়ির স্থানে ইটের বাড়ি। কুঁড়ে ঘরের স্থান নিয়েছে দালান। মানুষের জীবন যাত্রাকে আরও সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। ব্যবহার করা হচ্ছে নানা রকম প্রযুক্তি। আধুনিক যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে গ্রামের ঐতিহ্যবাহি ঢেঁকি।
বিশেষত ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত আবহমান বাংলায় ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি প্রায় সকল গিরস্থের বাড়িতে থাকতো। তবে, যান্ত্রিকতার প্রভাবে এখন আর চোখে পড়েনা। আর পত্নীতলা থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। এক সময় ভোরের আযানের পর স্তব্ধতা ভেঙে ঢেঁকির শব্দ ছড়িয়ে পড়তো গাঁও-গ্রামের চারিদিকে। গ্রামের মা চাচিরা এক সঙ্গে বসে নবান্নের আনন্দে মেতে উঠতেন। গ্রামের বিয়ে-শাদির উৎসবে ঢেঁকি শাঁটা চালের ফিরনি-পায়েসের ফরমায়েশ ছিলো অপরিহার্য। সে সময় ঢেঁকি ছাড়া একদিনও গ্রামের জীবনযাত্রা কল্পনা করা কঠিন ছিলো।
উৎসব- পার্বণে ধান থেকে আতব চাল তৈরী করতে, পিঠা বানাতে, চালের গুঁড়ি তৈরীতে ঢেঁকি শিল্পে গ্রামের মহিলারা ব্যস্ত সময় পার করতেন। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া বৃদ্ধা বা বয়স্ক মহিলারা গর্ভের সাথে বলতেন-এ ঢেঁকি আমার দাদা শ্বশুরের আমলের বা বাপের বাড়ির ঢেঁকি নিয়ে গল্প শুরু করতেন। পাশাপাশি গ্রামবাংলার ঘোমটা পরা বধুরা বিভিন্ন কায়দা- কসরতে ঢেঁকির তালে তালে বাপ -দাদার সময় থেকে চলে আসা গীত গেয়ে পরিবেশটি আনন্দঘন করে তুলতেন। তবে, যান্ত্রিক জীবন গ্রামীর জনপদের এ কর্মচঞ্চলতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ধান ভাঙার মেশিনের ভট-ভট শব্দ ঢেঁকির মধুময় শব্দকে গ্রাস করে নিয়েছে।
বর্তমানে শিল্পকনার অপর নাম ঢেঁকি। ঢেঁকির যৌবনে এর ব্যাপক কদর ছিলো। একই সঙ্গে সারাদেশে ঢেঁকি থেকে প্রকৃয়াজাত বিভিন্ন দ্রব্যের ব্যাপক কদর ছিলো। সারাদেশে লাখ লাখ পরিবার সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তৎকালিন সময়ে ঢেঁকির চাল বারানীরা তাদের উৎপাদিত চাল বিক্রি করে সংসারের খরচ মিটাতেন। উপার্জনকৃত অর্থ অন্যখাতে বিনিয়োগ বা সঞ্চয়ও করতেন। সময়ের পরিবর্তনে আধুনিক চাল মিলের পেশারের কারণে ঢেঁকি শিল্পীদের অনেকেই অর্ধাহারে- অনাহারে দিনমজুরি, ইটভাটা, ভিক্ষাবৃত্তিসহ অনাকাঙ্খিত বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হন। তা ছাড়া অনেকেই কাঁতা শেলাই আবার কেউ বা দর্জির কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেন।
বিশেষত এক সময় দেশের লাখ লাখ বিধাব বা তালাকপ্রাপ্ত নিম্নবৃত্ত পরিবারের মহিলারা সামাজিক সম্নানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন ছিলো গ্রামীন ঐতিহ্যটি এই ঢেঁকি শিল্প। এতে গ্রামীণ মহিলাদের কাছে ছিলো এটি অতীব প্রয়োজনীয় একটি কর্মসহায়ক হাঁতিয়ার।
বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত এক নাম গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহি ঢেঁকি। তবে তাদের কাছে এর কার্যকারিতা পরিচিত না হলেও প্রবাদ- প্রবচনে ‘ঢেকিঁ’ শব্দটি কিছুটা হলেও পরিচিত। এদিকে অন্যান্য পুরাকৃতির সঙ্গে এক সময় হয়তো জাদুঘরে ঠাঁই হবে গ্রাম বাংলার এ ঐতিহ্যবাহি ঢেঁকি। আর ভবির্ষ্যত প্রজন্ম ঢেঁকি দেখে চোখের ক্ষুধা মেটাবেন আর শিক্ষার্থীরা ‘ঢেঁকি’ কে গবেষণার উপকরণ হিসাবে হয়তো ব্যবহার করবেন।