ঢাকা | শনিবার
২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৯ বছর পরিত্যক্ত বিসিকের সাড়ে ২৮ লাখ টাকার ভবন

৯ বছর পরিত্যক্ত বিসিকের সাড়ে ২৮ লাখ টাকার ভবন

রংপুরে বিসিকের অফিস কাম বেনারসি পল্লীর কাপড় বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্রটি পরিত্যক্ত পড়ে আছে প্রায় ৯ বছর ধরে। সরকারি প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত দ্বিতল এ ভবনটি কোনো কাজে আসছে না। অথচ এটি বেনারসিশিল্পের প্রসার ও কারিগরদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই নির্মাণ করা হয়। স্থানীয়দের দাবি, শুধু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার অজুহাতে আজ পর্যন্ত ভবনটিতে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। এতে বিসিক থেকে তৈরি করা এ ভবনের সুফল পাচ্ছেন না তারা। দ্রুত বেনারসি পল্লীর উন্নয়ন ও শিল্পের বিকাশে দ্বিতীয় প্রকল্প চালু করাসহ অব্যবহৃত ভবনটি সংস্কার করে সেখানে কার্যক্রম শুরুর দাবি জানিয়েছেন তাঁতিরা।

সম্প্রতি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা হাবু তাঁতিপাড়া এলাকায় গেলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জরাজীর্ণ এ ভবনটি চোখে পড়ে। পোড়োবাড়ির মতো দ্বিতল এ ভবনটি ব্যবহার না করায় আগাছায় ভরে গেছে। দেয়ালের রং বদলে হয়ে আছে স্যাঁতসেঁতে। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ এ ভবনের অনেক স্থান থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভেতরের দরজা-জানালাসহ আসবাবও নষ্ট প্রায়। বিদ্যুতের ওয়ারিং নষ্ট হওয়াসহ সীমানাপ্রাচীর কোথাও ভেঙে গেছে।

ভবনটি চালু করতে চেষ্টা করেছেন তাঁতিপাড়ার বেনারসি উদ্যোক্তারা। বহুবার তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিসিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি নতুন করে প্রকল্প শুরুর প্রস্তাব।

বেনারসি পল্লিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা গজঘণ্টা হাবু তাঁতিপাড়ার অধিকাংশ মানুষ এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তাঁতিপাড়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁত মেশিনের মাকু, সানা, দক্তি আর নরাজের ঠকঠক শব্দ শোনা যায়। এখানকার কারখানাগুলোয় তৈরি হয় বেনারসি ছাড়াও নিট কাতান, রেশমি কাতান, রিমঝিম কাতান, প্রিন্স কাতান, জামদানি, বারবুটা, কুচিকাটা, ফুলকলিসহ হরেক নামের শাড়ি ও থ্রি-পিস।

এখানকার তাঁতশিল্পের প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রহমান। তার দেখাদেখি প্রতিবেশীরাও ঝুঁকে পড়েন এ শিল্পে। দেখতে দেখতে এ শিল্পের প্রসার ঘটে। এখন হাবু গ্রামের সবাই এখন তাঁতি। একসময় প্রায় ৬০০ তাঁত ছিল এই পল্লিতে। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদিত কাপড়ের বাজারব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, শ্রমিক-সংকট, স্থানীয়ভাবে সুতা না পাওয়ার প্রভাব পড়েছে সম্ভাবনাময় এই শিল্পে। সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রসেসিং ও কাটিং মেশিন না থাকাসহ নানা সমস্যা।

বেনারসি শাড়ি বুননে ব্যস্ত কারিগরদের একজন মনোয়ারুল। করোনা আর বন্যা পরিস্থিতিতে কাজের অভাব তাকে বেশ ভুগিয়েছে। এই তাঁতশিল্পী বলেন, হামার এলাকার অনেকোত বিসিক থাকি প্রশিক্ষণ দিছে। এ্যাতে হামার উপকার হইছে। কিন্তু প্রকল্প শুরুর সময় স্যারেরা বিল্ডিং করি হামার তৈরি শাড়ি কাপড় প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করা কথা কইছে। কিন্তুক প্রকল্পের শ্যাষ সময়ে বিল্ডিং হইলেও এটা এ্যালা আর কোনো কাজোতে নাগোছে (লাগছে) না। নয় বছর ধরি বিল্ডিংটা পড়ি থাকি নষ্ট হওচে। লাখ লাখ টাকা দিয়্যা বানা এই বিল্ডিংটা চালু করা নিয়্যা কোনো উদ্যোগ নাই।

একই এলাকার তাঁতশিল্পী রাশেদা বেগম। বিভিন্ন উদ্যোক্তার কারখানায় চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন তিনি। চরকার সুতা তোলার ফাঁকে রাশেদা বলেন, বেনারসিশিল্প টিকে থাকলে আমরা ভালো থাকব। কিন্তু অবস্থা খুবই খারাপ। সরকার থেকে আগের মতো পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। এখানে বিসিক থেকে বেনারসি কাপড় বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই কেন্দ্রটি চালু করতে পারেনি। এটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে না রেখে এলাকার তাঁতিদের কাউকে সরকারি নিয়ম মেনে ব্যবহারের সুযোগ করে দিলেও লাখ লাখ টাকায় তৈরি ভবনটি কাজে লাগবে।

ভবনসংলগ্ন বাসিন্দা সুমন মিয়া, রওশানুল ইসলাম, আব্দুল কুদ্দুস, আফজালসহ আরও অনেকেই চাইছেন, ভবনটি চালু হোক। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে ঝিমিয়ে পড়া বেনাসরি পল্লিকে আবার জেগে তুলতে উদ্যোগ নেবে সরকার।

তাদের অভিযোগ, দ্বিতল এ ভবনটি নির্মাণের শুরু থেকে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় এটি স্থানীয়দের কোনো উপকারে আসছে না। বেনারসি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান থাকলে ভবনটিতে কার্যক্রম চালু থাকত। এতে উপকৃত হতো এ এলাকার দরিদ্র মানুষ। এ কারণে তারা প্রকল্প শুরু করাসহ ভবনটি রক্ষায় সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।

এ প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাঁতি বর্তমানে সফল উদ্যোক্তা ফাইয়াজ বেনারসির স্বত্বাধিকারী ফরিদা রহমান বলেন, বেনারসিশিল্পের উন্নয়নে দ্বিতীয় প্রকল্প চালু না হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। তিনি বলেন, আগে হাবু ও এর আশপাশে প্রায় সহস্রাধিক তাঁত ছিল। এতে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাভবান হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রকল্প চালু না থাকায় বেনারসি পল্লিতে দক্ষ কারিগরের সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) রংপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত চার বছরের জন্য বেনারসি পল্লির উন্নয়ন ও কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রথম প্রকল্প শুরু হয়। সংশোধনীসহ কয়েকটি ধাপে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে পাঁচটি ট্রেডে ৪৩টি প্রশিক্ষণ ব্যাচে ৮৬০ জন তাঁতি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ ও ঋণের মাধ্যমে ১২০টি তাঁতের দ্বারা ৩০টি তাঁতি পরিবারের ২৫০ জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাও হয়।

প্রকল্পের শেষের দিকে বেনারসিশিল্পের প্রসারে উৎপাদিত শাড়িসহ অন্যান্য কাপড় প্রদর্শন ও বিক্রয় কাম অফিসের জন্য ২ হাজার ২৫২ বর্গফুট আয়তনের দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় ২৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বেনারসি পল্লি উন্নয়নে দ্বিতীয় প্রকল্প চালু না হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে তাঁতিপাড়ায় নির্মিত বিসিকের অফিস কাম বিক্রয় ও প্রদর্শন কেন্দ্রটি।

রংপুর বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক মো. শামীম হোসেন বলেন, বেনারসি পল্লি উন্নয়ন প্রকল্পের শেষের দিকে ভবনটি নির্মিত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় প্রকল্প চালু না হওয়ায় ভবনটিতে কোনো কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়নি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভবনটি ভাড়া দেওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, আমরা স্থানীয় তাঁতিদের বিভিন্ন দাবিসহ নতুন করে প্রকল্প চালু ও ভবনটি ব্যবহার উপযোগী করতে মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠিয়েছি। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকায় ভবনটি এখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন