খাদ্য ও কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চল খ্যাত শেরপুরে এবার বাণিজ্যিকভাবে কলা চাষ হচ্ছে। এতে ভাগ্যবদল হচ্ছে এখানকার শত শত চাষীর। স্বল্প ব্যয়ে ভাল ফলন, পুষ্টিমান ও বাজার থাকায় অধিক লাভ পাওয়ায় ক’বছর আগে থেকেই কলা চাষে মনোযোগী হয়ে পড়েছেন এ অঞ্চলের অনেক চাষী। ক্রমেই কলা চাষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় বর্তমানে তা বানিজ্যিক চাষাবাদে রূপ নিয়েছে। এ এলাকার উৎপাদিত কলার পুষ্টিগত মান ভিন্ন হওয়ায় অনেক অঞ্চলে তার বিশেষ কদরও রয়েছে। ফলে নিজ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে পাঠিয়ে একদিকে কলা চাষীদের যেমন হচ্ছে ভাগ্যবদল, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে ওঠায় পাল্টে যাচ্ছে কোনো কোনো এলাকার চিত্রও।
কৃষিপ্রধান শেরপুরে ধান ও শস্য-সবজি উৎপাদনই কৃষকের প্রধান ফসল হলেও আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ অঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে নতুন নতুন ফসল উৎপাদনের চর্চা। তারই আওতায় শেরপুর সদর ও নকলাসহ সীমান্তবর্তী বিস্তৃত এলাকায় গত ৫-৬ বছর ধরে যেমন বেড়েছে সাগর ও সবরী কলাসহ বাহারি কলার চাষ, ঠিক তেমনি আপেলকুল, লটকন, স্টবেরি, ড্রাগনসহ নানা ফলের গড়ে উঠছে বাগান। তবে ক্রমবর্ধমান কলা চাষ এ অঞ্চলের অনেক চাষীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে। এজন্য শেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় একরের পর একর জমি এবং বাড়ির আশপাশ, ডোবা, নালার পাশে বিভিন্ন জাতের সবরি কলা, চিনি চাম্পা কলা, বিচি কলা ও সাগর কলার গাছ লাগানো রয়েছে। গত বছরের জুনের শুরুতেই কলা চাষীরা জমিতে গোবর, ইউরিয়া, পটাশ, ফসফেট সার মিশিয়ে জমি তৈরি করে তাতে ৩ হাত ফাঁকা করে কলার চারা লাগিয়েছেন। ৮ থেকে ৯ মাসের মধ্যে প্রতিটি গাছে কলার মোচা এসেছে। বর্তমানে প্রায় গাছের কলা বাজারজাত করার উপযোগী হয়ে উঠেছে। চাষীরা জানান, এক বিঘা জমিতে কলা চাষ করতে খরচ হয় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। বিঘাতে প্রায় ৩৬০ থেকে ৩৮০টি গাছ লাগানো যায় এবং প্রতিটি গাছে কলার ছড়া ধরে। কলাচাষীরা বর্তমানে বড় ছড়া বিক্রি করছেন সাড়ে ৪শ’ টাকা। মাঝারি ছড়া সাড়ে ৩শ’ টাকা এবং ছোট ২শ’ থেকে ২৫০ টাকায়। ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করে একজন বাগান মালিক কলা বিক্রি করছেন প্রায় ২ লাখ টাকা। প্রথম চালান কলা কাটার পর গাছটি কেটে ফেলেন। সেই কাটা গাছের গোড়া থেকে আবারও কুশি বের হয়ে থাকে। সেই কুশি থেকে আবার দ্বিতীয় চালান কলা ধরে। এভাবে একজন কলাচাষি বাগান থেকে দু’বার কলা বাজারজাত করেন। তবে দ্বিতীয়বারে কলার আকার অনেকটা ছোট আকৃতির হয়। অন্য যে কোন ফসলের চেয়ে অনেক বেশি লাভ হয় কলা চাষে। ফলে অন্য ফসলের পাশাপাশি এখন কলা চাষ বেশি হচ্ছে।
বাণিজ্যিকভাবে শেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় সাগর ও সবরি কলাসহ বিভিন্ন জাতের কলা চাষ করা হয়েছে। ওইসব জাতের গাছ থেকে অল্প দিনেই ফল পাওয়া যায়। তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ফসলের চেয়ে কলার দামও বেশি। সাধারণত বৈশাখ মাসে কলার চারা রোপণ করলে অগ্রহায়ণ মাস থেকে কলা পাওয়া শুরু হয়।
শেরপুর সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের কলা চাষী আতাব উদ্দিন বলেন, এক বিঘা জমিতে কলার বাগান করেছি। এটা আমার নতুন বাগান। প্রতিটি গাছে কলা ভাল হয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে কলা কাটতে শুরু করেছি। বড় ছড়াগুলো সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা দরে বিক্রি করছি এবং মাঝারি ছড়াগুলো ৪শ’ এবং ছোট ৩শ’ টাকায় বিক্রি করছি। একই এলাকার আব্দুল খালেক বলেন, এ বছর দেড় বিঘা জমিতে কলার চাষ করেছি। ফলন অনেক ভাল। দামও ভাল। নিমতলা এলাকার লিটন মিয়া বলেন, কলা চাষে লাভের পাল্লাই ভারি থাকে। গাছ লাগানো থেকে শুরু করে, ১১ মাসের মধ্যে কলা কাটা বা ছড়ি নামানো যায়। এর মধ্যে কলা পাওয়া যায় ৩শ’ থেকে ৩২০টি। যোগিনীবাগ এলাকার চাষী আব্দুর রহিম বলেন, আমি এবার ২ বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছি। এখনও কলা বিক্রি শুরু করিনি। ফলন দেখে মনে হচ্ছে সব খরচবাদে বিক্রি করে ৭০ হাজার টাকা আয় আসবে।
কলা ব্যবসায়ী ও আড়তদার হাবিবুর রহমান, বিপুল মিয়া ও শামীম মিয়া বলেন, বাগানে কলার ছড়ি আসার পর পরই চাষীদের কাছ থেকে প্রতি ১শ’ ছড়ি ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় কিনেন তারা। পরে সময় হওয়া সাপেক্ষে সেগুলো কেটে আড়তে নিয়ে এসে প্রাকৃতিক উপায়ে পাকিয়ে প্রতি পুন (২০ হালি বা ৮০পিছ) ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় পাইকারিতে বিক্রি করেন তারা। এতে তারাও লাভবান হন।
এ ব্যাপারে শেরপুর খামারবাড়ির ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সুলতান আহম্মেদ বলেন, কলা একটি লাভজনক ফসল। সল্প ব্যয়ে অধিক লাভ পাওয়ায় এখন শেরপুরে বাণিজ্যিকভাবে কলা চাষ হচ্ছে। চলতি মওসুমে প্রায় ১ হাজার ৩শ’ চাষী কলা চাষ করেছেন। কৃষি বিভাগের তরফ থেকে তাদের নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। চাষের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ শ’ ২৯ হেক্টর জমি। তা থেকে উৎপাদন হবে প্রায় ৩ হাজার ২০৫ মেট্রিকটন কলা। কোন রোগবালাই না দেখা দেয়ায় চলতি মওসুমে জেলায় কলার বাম্পার ফলন হতে পারে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।