ঢাকা | শুক্রবার
২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বহুমুখী পদক্ষেপ

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বহুমুখী পদক্ষেপ

যেসব সিদ্ধান্ত

  • ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ
  • এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ঘোষণা
  • সপ্তাহে একদিন পেট্রল পাম্প বন্ধ
  • হোম অফিস বা কমে আসবে সময়

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে। শ্রীলংকায় জ্বালানি সংকটের মুখে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের চেষ্টায় সরকারি কর্মচারীদের ঘরে বসে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে দেশটি। সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে কলম্বো ও আশপাশের স্কুল। বিদ্যুৎ সংকটে ভারত ও পাকিস্তানের অনেক স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা এবং বাড়িঘরে এসি না চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাপান ও ফ্রান্স সরকার। শঙ্কা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশেও। জ্বালানি তেল ও কয়লা সংকটে অনেক দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধার মুখে পড়েছে। জ্বালানি সাশ্রয়ে নানা নির্দেশনা জারি করেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার। ফলে গ্যাস সরবরাহ গত কয়েক দিনে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। ফলে কমাতে হয়েছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের  উৎপাদন। একইভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। সাধারণত গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হয়। কিছুদিন ধরেই ধাপে ধাপে কমানো হচ্ছে সরবরাহ। এলএনজি কেনা না হলে আপাতত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৪০ ডলার ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ কেনা হয়েছিল ২৫ ডলারে।

ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ

আজ থেকেই ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলে, দেশের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থগিত করা হয়েছে। ফলে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে। সে কারণে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে লোডশেডিং বাড়বে। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জানান, পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেওয়া হবে। আমাদের গ্যাসেরও সংকট আছে। সে কারণেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। ফলে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট। কখন, কোন এলাকায়, কতক্ষণ লোডশেডিং হবে, তা আমরা আগে থেকে জানিয়ে দেবো। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন-  প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

আজ থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং

তৌফিক-ই-এলাহী বলেন, পৃথিবীতে একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ইউক্রেনের যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধ কিন্তু আমাদেরও যুদ্ধ। ওই যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে আমাদের ওপর। আগামীকাল (আজ) থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ে যাচ্ছে দেশ। জ্বালানি তেলের লোকসান কমাতে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব এলাকায় লোডশেডিং থাকবে তা আগে থেকেই গ্রাহকদের জানিয়ে দেওয়া হবে। দিনে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং থাকবে। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, যাদের অর্থের অভাব নেই, তারাও কিন্তু লোডশেডিং করছে। যুক্তরাজ্যে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় হচ্ছে। উৎপাদনকে কমিয়ে খরচ যাতে সহনশীল হয়, সে পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। ডিজেলের বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাতত স্থগিত করলাম, তাতে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে। মনে রাখতে হবে, ডিজেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সরকারি-বেসরকারি অফিসের সময় এক থেকে দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনা যায় কি না, সে বিষয়টিও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

এদিকে, সরকারি-বেসরকারি অফিস ভার্চুয়ালি করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে সভায়। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিসের সময় এক থেকে দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনার চিন্তাও করা হচ্ছে, তবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন।

ঢাকার কোন এলাকায় কখন লোডশেডিং

ডিজেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থগিত করে আজ থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ে যাচ্ছে দেশ। দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টা, কোথাও কোথাও দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হবে। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকের পর বিভিন্ন এলাকার জন্য লোডশেডিংয়ের শিডিউল প্রকাশ করেছে ঢাকা শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের বিষয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে। দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টা, কোথাও কোথাও দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হবে।

ঢাকা ও আশপাশের ৩৬টি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ডিপিডিসি। ঢাকার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুৎসেবা দিচ্ছে: আদাবর, আজিমপুর, বনশ্রী, বাংলাবাজার, বংশাল, বাসাবো, ডেমরা, ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, জুরাইন, কাকরাইল, কামরাঙ্গীরচর, খিলগাঁও, লালবাগ, মানিকনগর, মাতুয়াইল, মগবাজার, মতিঝিল, মুগদাপাড়া, নারিন্দা, পরীবাগ, পোস্তগোলা, রাজারবাগ, রমনা, সাতমসজিদ, শ্যামলী, শেরেবাংলা নগর, শ্যামপুর, স্বামীবাগ ও তেজগাঁও এলাকায়।

তবে গ্রাহকরা সাশ্রয়ী হলে লোডশেডিং শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাই সবাইকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বিকাশ দেওয়ান বলেন, ভোক্তারা সাশ্রয়ী হলে লোডশেডিং শূন্যে নিয়ে আসা সম্ভব। কোনো ঘরে যদি ১০টি লাইট থাকে, প্রয়োজন ছাড়া সবগুলো যদি ব্যবহার না করে, তাহলেই বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ খরচ না করলেও লোডশেডিং না দিয়েও গ্রাহককে সেবা দেয়া সম্ভব।

যেভাবে জানা যাবে লোডশেডিংয়ের শিডিউল

কোথায় কখন লোডশেডিং হবে এ তথ্য কীভাবে জানা যাবে- জানতে চাইলে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান বলেন, এলাকাভিত্তিক সম্ভাব্য লোডশেডিংয়ের তালিকা করে ওয়েবসাইটে আপলোড করে দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকরা ওয়েবসাইটে গেলেই সেখানে একটি লিংক পাবেন, সেখানে ক্লিক করে তাদের এলাকার সম্ভাব্য লোডশেডিংয়ের সময় জানতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বৈঠকে দেশের সব বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিকে এ ধরনের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। গ্রাহকরা এ তথ্য কীভাবে পাবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিগগিরই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওয়েবসাইট ও লিংক প্রকাশ করা হবে। পরে দুপুর দেড়টার দিকে ডিপিডিসির ওয়েবসাইটে গিয়ে এ সংক্রান্ত একটি লিংক পাওয়া যায়। বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া এমন লিংকেই লোডশেডিংয়ের তথ্য পাওয়া যাবে।

সপ্তাহে একদিন বন্ধ পেট্রল পাম্প

জ্বালানি তেলের লোকসান কমাতে সপ্তাহে একদিন পেট্রল পাম্প বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের কথা জানান প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সাময়িক লোডশেডিংয়ের সময় সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া অফিসের সময় কমানো যায় কি না, সে বিষয়টিও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বৈঠকে দেশে ডিজেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনও স্থগিতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সঙ্কট সমাধানে আপাতত মহামারিকালের মতো হোম অফিস চালু করা, অফিসের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে সুপারিশ পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

হোম অফিস কিনা সিদ্ধান্ত শিগগিরই

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অফিসের সময় কমানো হবে নাকি বাসা থেকে করা হবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দ্রুতই নিতে যাচ্ছে সরকার। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। ফরহাদ হোসেন বলেন, অফিসের সময় কমানো হতে পারে। অথবা হতে পারে ওয়ার্কফ্রম হোম। অফিসে যতটুকু না করলেই নয় এমনভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি চিন্তা করছি। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে জানাবো। মানুষের কষ্ট যাতে না হয় সেটা বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নেবো। বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কেউ বলছে অফিস সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা বা ৪টা পর্যন্ত করতে। তবে এটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। যেটা করলে ভালো হয় সেটাই হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা। সব বিষয় বিশ্লেষণ করে সঠিক কাজটি করার চেষ্টা করবো।

সংবাদটি শেয়ার করুন