ঢাকা | মঙ্গলবার
৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পর্যটনখাতে সম্ভাবনাময় চলনবিল

পর্যটনখাতে সম্ভাবনাময় চলনবিল

প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তনবিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খালের সমন্বয়ে গঠিত উত্তর জনপদের এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ঐতিহ্যবাহী চলনবিল। বর্ষায় অথৈ পানিতে খেলা করে উথালপাথাল ঢেউ। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্নমাত্রা যোগ হয় চলনবিলের বহুমাত্রিক সৌর্ন্দযের। বর্ষায় সৈকতের মতো বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে  অপরূপ সাজে সজ্জিত থাকে এ বিল। শরতে শান্ত জলরাশির সঙ্গে যোগ হয় অপূর্ব সবুজের সমারোহ। হেমন্তে পাকা ধানের সোনালি রং আর গন্ধে মাতোয়ারা থাকে চারদিক। শীতে হলুদ আর সবুজের সমারোহ ঢেকে যায় পুরো চলনবিল। গ্রীষ্মের তাপদাহে চলনবিল অঞ্চলে দেখা দেয় পানি সংকট। বর্ষা ঋতুতে চলনবিলের জৌলুস ফিরে আসে।

বর্তমান চলনবিলে নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম; পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন, আটটি পৌরসভা ও এক হাজার ৬০০টি গ্রাম রয়েছে। পুরো অঞ্চলের লোকসংখ্যা ২০ লাখের বেশি। (চলনবিলের ইতি কথা)

উত্তর জনপদে চলনবিলের ইতিহাস বিশাল ও সমৃদ্ধশালী। চাটমোহরে জগৎশেঠের কুঠির, বুড়াপীরের দরগা; সিংড়ায় ৩৫০ বছর আগে হজরত ঘাসি দেওয়ান রহ. এর মাজার শরিফ; ফরিদপুরের বনওয়ারীনগর জমিদারবাড়ি; সিরাজগঞ্জের তাড়াশের বিনসরায় দেখা মিলবে কিংবদন্তি বেহুলা সুন্দরীর বাবা বাছো বানিয়া ওরফে সায় সওদাগরের বসতভিটা ‘জিয়ন কুপ’। এছাড়া নাটোরের গুরুদাসপুরে খুবজিপুর গ্রামে দেখা যাবে, চলনবিলে ঐতিহ্যবাহী জাদুঘর। এখানে পাবেন চলনবিলাঞ্চলের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র।

তাড়াশে সম্রাট রায় বাহাদুরের বাড়ির ধ্বংসস্তুপ। দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির, কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমামবাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদারবাড়ি। হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির। রায়গঞ্জের জয়সাগর। চাটমোহরের হরিপুরে লেখক প্রমথ চৌধুরী ও বড়াইগ্রামের জোয়াড়িতে লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বুকে ধারণ করে আছে চলনবিল।

বেহুলা-লখিন্দরের উপকথা শুনে কে না মোহিত হয়। লখিন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগর মনসা দেবিকে মানত না, তাই নিয়ে কত কাণ্ড। সেই চাঁদ সওদাগরের সময় চাঁদের বাজার লাগত চলনবিল পাড়ে। বাস্তুল হাইস্কুলের ঠিক পাশের ভিটায় বিনসাড়া গ্রামে রয়েছে বেহুলা-লখিন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশেই আছে বেহুলার কুয়া (কূপ)। বেহুলা চাঁদের বাজারে যে নৌপথ দিয়ে যাতায়াত করত সেটি বেহুলার খাড়ি নামে পরিচিত। বেহুলার খাড়ি নামক এ জোলা এখনো রয়েছে। খাড়ির পাশে নৌকাসদৃশ ডিবি রয়েছে। গ্রামের লোকজন এখনো বিশ্বাস করে, ডিবির নিচে বেহুলার নৌকা রয়েছে। নিমগাছি হাটের পশ্চিমে জয়সাগর নামে এক বিশাল দীঘি রয়েছে। এ দীঘি নিয়ে নানা উপকথা প্রচলিত রয়েছে। রাজা অচ্যুত সেন এক যুদ্ধে জয়লাভ করে বিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ জয়সাগর খনন করেছিলেন। দীঘি ১২ বছর ধরে খনন করার পরও নাকি এ দীঘিতে পানি ওঠেনি। এক রাতে রাজাকে এক সাধু স্বপ্নে দেখায় তার ছেলেকে বিয়ে দেয়ার পর বাসর রাতে সে দীঘিতে নেমে একমুঠো মাটি তুললে পানি উঠবে। রাজার ছেলে তা করায় দীঘি পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে, রাজকুমারের সলিল সমাধি ঘটে। এরপর রাজবধূও সেখানে প্রাণ বিসর্জন দেয়। এ রাজবধূ নাকি অভিশাপ দিয়ে যায় কেউ এর পানি ছুঁবে না। লোকে ভয়ে এর পানি ব্যবহার না করায় জঙলে ভরে যায় দীঘি। দীঘির মাঝে বেলগাছ জন্মে। সেই বেলও ভয়ে কেউ ছুঁতো না। তবে, এখন সেখানে মাছের চাষ হচ্ছে। সেই বেল গাছটি এখন আর নেই।

সিরাজগঞ্জের বনপাড়া হাটিকুমরুল বিশ^রোড হয়ে কাছিকাটা টোলপ্লাজা হয়ে সহজেই চলনবিলে প্রবেশ করা যায়। সার্বিক বিবেচনায় বৃহৎ চলনবিলের পুরো অংশ একদিনে ঘুরে দেখা কষ্টসাধ্য। পুরো চলনবিল ঘুরে দেখতে দর্শনীয় স্থানগুলো আগে চিহ্নিত করে নিতে হবে। চলনবিলের অপরূপ দৃশ্যকে উপভোগ করতে বর্ষাকালকে বেছে নিলে ভালো হবে।

নাটোর-৪ আসনের সাংসদ ও নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ছোঁয়ায় নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরীসহ পুরাকৃতির কারণে অবহেলিত চলনবিল এখন পর্যটকদের আর্কষিত করছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উত্তর জনপদের চলনবিল হতে পারে দেশের একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র।

সংবাদটি শেয়ার করুন