এক সময় সর্বত্র চোখে পড়ত কদম গাছ। বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ত সেই কদম ডালে ফোটা ফুল থোকা থোকা। বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে আদিকাল থেকে কদম আমাদের প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে আসছে। বর্ষার আগমনে যেন কদম ফুলের হাসি ফুটেছে। প্রকৃতি সাজে ভিন্নরূপে। আর তাই তো কদম ফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত। তবে, সময়ের পরিক্রমায় কদম ফুলের গাছগুলো এখন আর কেউ রোপন করেনা। তবে বন জঙ্গলে এ বৃক্ষটি তার ফলের বীজ থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে ঝোপ জঙ্গলে জন্মাতো। নির্বিচারে কর্তণের ফলে এ বৃক্ষটি এখন বিলুপ্তির পথে।
আষাঢ় ও শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল। বাঙালির প্রিয় ঋতুর একটি। আর এ বর্ষাতেই কদম ফুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ যুগে যুগে শহর কিংবা গ্রামবাসীকে মুগ্ধ করে। ফুলে সৌরভ না থাকলেও এর সাদা-হলুদ রঙ নজর কেড়ে নেয়। বর্ষা এলেই কদম ফোটে, চোখ ধাঁধিয়ে দেয় পুষ্পপ্রেমীদের। খাল-বিলের উপচেপড়া জল যেমন শাপলাকে সাজিয়ে তোলে, ভাসিয়ে রাখে, তেমনি পরিবেশকে মাতিয়ে তোলে বর্ষার কদম ফুল। বর্ষা মানেই হলুদ-সাদা মিশ্র রঙের কদম ফুলে গাছ ছেয়ে যাওয়া। বর্ষা মানেই গুচ্ছ গুচ্ছ কদম ফুলের মিষ্টি সুবাস।
বর্ষা প্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথ তার বর্ষার কালজয়ী গানে লিখেন, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান। তবে সেই বর্ষার ফুল যখন গ্রীষ্মের তাপদাহে দেখা মেলে তখন তা একটু বিচিত্রই। শাহজাদপুরের বেশ কটি এলাকায় এখন কদমের ডালে ডালে ছেয়ে গেছে ফুলে। আর তার অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ করছে সবাইকে।
কদম গাছের শাখায় পাতার আড়ালে ফুটে থাকা অজস্র কদম ফুলের সুগন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ কারণেই কদম ফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত। কদম ফুলের আরেক নাম হলো নীপ। ফুলের সৌন্দর্যের মতো আরও কিছু সুন্দর তবে অপ্রচলিত বাংলা নাম রয়েছে- যেমন বৃত্তপুষ্প, সর্ষপ, ললনাপ্রিয়, সুরভী, মেঘাগমপ্রিয়, মঞ্জুকেশিনী, কর্ণপূরক, পুলকি, সিন্ধুপুষ্প ইত্যাদি। কদম বর্ণে, গন্ধে, সৌন্দর্যে ও ধরনে এ দেশের অপরুপ ফুল গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম।
কদম গাছের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার সম্পর্ক সুবিখ্যাত। আর কদম ফুল নিয়ে আমাদের আকুলতার নমুনা পাওয়া যায় প্রাচীন বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে লোকগাথা, পল্লীগীতি ও রবীন্দ্র-কাব্য পর্যন্ত। ভানুসিংহের পদাবলি, বৈষ্ণব পদাবলি ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে নানাভাবে নানা আঙ্গিকে এসেছে কদম গাছের কথা। বহুল উপমায় বিভূষিত তার গুণগাথা। কদম গাছ নিয়ে গ্রামবাংলার নানা ছড়া-কবিতাও রয়েছে। ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদম তলায় কে/ হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে সোনামণির বে’- এমন বহু ছড়ায় এখনও কদমের সুষমা প্রকাশ পায় মানুষের মুখে মুখে।
প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা বর্ষার স্মারক কদম ফুল। কদমের শুভ্ররাগে হৃদয় রাঙিয়ে নেয়ার সুযোগ এখন শহুরে লোকের কমই আছে। শুধু শহর নয় গ্রাম থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে কদম। চোখ জুড়ানো ঘন সবুজ পাতার মধ্যে সাদা-হলুদ মঞ্জুরি ফুলের চিরচেনা কদম গাছ এখন চোখে পড়ে কমই। বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান/মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে এই-যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না ক্লান্ত রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল। এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে তব বিস্মৃতি স্রোতের লাবনে ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান কবিগুরুর বিখ্যাত এই গানের শুভ্র কদম ফুল এখন আর রাঙাতে পারে না মানুষের মন।
চিরচেনা কদম গাছ এখন তেমন চোখে পড়ে না। বর্ণে গন্ধে সৌন্দর্য্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর অন্যতম হলেও অবহেলা-অনাদরে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এ গাছ। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় এক সময় প্রচুর চোখে পড়ত কদম গাছ। এক সময় তো কদমগাছ ছাড়া কোনো গ্রাম আছে এটা কল্পনাই করা যেত না। এখন দশ গ্রাম ঘুরেও কদমের দেখা পাওয়া যায় না। কদম ছাড়া বর্ষা একরকম বেমানান। বনবিভাগের কর্মকর্তারাদেরও এই বৃক্ষটির চাড়া তৈরী ও রোপনের কোনো উদ্যোগ নেই। প্রকৃতির ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে অন্য গাছের পাশাপাশি কদম গাছ রোপণ করা প্রয়োজন। যদি না করা হয় তাহলে বলা যায় না অবহেলায় একদিন হয়তো হারিয়ে যাবে এই গাছটা। তখন হয়তো কদম ছাড়াই বর্ষা উদযাপন করতে হবে আমাদের।