ঢাকা | বুধবার
৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাটির নিচে সমৃদ্ধ ইতিহাস

মাটির নিচে সমৃদ্ধ ইতিহাস

১৮০৮ সালে চিহ্নিত করেন ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন

বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ মহাস্থানগড় বা পুন্ড্রনগর। এটি পুণ্ড্রবর্ধন নামেও পরিচিত। তৎকালীন বাংলার রাজধানী ছিল পুন্ড্রনগর। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই জনপদ গড়ে ওঠে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর তীরে মহাস্থান গড় অবস্থিত। শিবগঞ্জ উপজেলার মধ্যে এই গড়। ২০১৬ সালে মহাস্থানগড়কে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে।

ইতিহাস

চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ্গ ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ সালের মধ্যে ভ্রমণ শেষে ধারাবাণীতে বলেন এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান ছিল। চীন ও তীব্বত থেকে ভিক্ষুকরা আসতেন মহাস্থানে লেখাপড়া করতে। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন (১০৮২-১১২৫) গৌড়ের রাজা থাকাকালে এই গড় অরক্ষিত ছিল। তখনকার পুন্ড্রনগরের রাজা ছিলেন নল। আর তার বিরোধ চলত আপন ভাই নীলের সাথে। এসময় ভারতের শ্রীক্ষেত্র থেকে অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ আসেন। যিনি পশুরাম হিসেবে পরিচিত পরবর্তীতে রাজা বনে যান পুণ্ড্রনগরের।

এ সময় ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে বাংলায় আসেন হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী(র) ও তার সাথীরা। কথিত আছে তিনি করতোয়া নদী পার হয়েছিল বিশাল মাছ আকৃতির নৌকার পীঠে চড়ে। মহাস্থানগড় পৌঁছে ধর্ম প্রচার করতে থাকলে রাজা পশুরামের সাথে বিরোধ দেখা দেয়।

রাজা হওয়ার পর থেকেই পশুরাম জনগণের কাছে অত্যাচারী শাসক হয়ে যায়। জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকলে শাহ সুলতানের (র.) সাথে যুদ্ধ বেঁধে যায়। যুদ্ধে রাজা পশুরাম জিয়ৎ কুণ্ড কূপের পানির বিশেষ সাহায্য নেয়। তার আহত সৈন্যদের সেই কূপের পানি পান করে আহত সৈন্য সুস্থ হয়ে যায়। তাই হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.) একটি ঈগল পাখির মাধ্যমে এক টুকরো মাংস ওই কূপে ফেলে দেন। এতেই কূপের পানি আশ্চর্য গুণ হারিয়ে ফেলে। শেষমেষ পরশুরাম পরাজয় বরণ করে।

মহাস্থানগড়ে শাহ সুলতান মাহমুদের (র.) মাজার শরীফ রয়েছে। তার সামনেই বিখ্যাত কটকটির দোকান রয়েছে। এখানকার একটি জনপ্রিয় খাবার হিসেবে বেশ পরিচিত।

গড়ের আবিস্কার

১৮০৮ সালে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন প্রথম এই গড় চিহ্নিত করেন। পরে ১৮৭৯ সালে আলেক্সান্ডার এই ঐতিহাসিক নগরীকে পুণ্ড্রনগরের রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ব্রাহ্মী লিপির সন্ধান মেলে। সেই লিপির লেখার মাধ্যমে  প্রাদেশিক সরকার সম্রাট অশোক দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে রাজভান্ডার থেকে খাদ্য ও টাকার সাহায্য দিতে নির্দেশ দেন।

দর্শনীয় স্থানের বিবরণ জেনে নেওয়া যাক-

ভাসু বিহার: এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মপীঠ ছিল। এটি স্থানীয়ভাবে নরপতি ধাপ নামেও পরিচিত। এখানে বৌদ্ধদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।

গোবিন্দ ভিটা: এটার অর্থ হলো দেবতা বিষ্ণুর আবাসস্থল। এখানে মন্দির থাকলেও বৈষ্ণব ধর্মের কোনো নির্দশন পাওয়া যায়নি।

শীলাদেবীর ঘাট: এটি করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। রাজা পশুরামের বোন ছিল শীলাদেবী। যখন শাহ সুলতান মাহমুদ বলখীর (র.) কাছে তার ভাই পরাজিত হয় তখন তিনি সেই ঘাটে আত্মহত্যা করেন।

ভীমের জাঙ্গাল: এটি মূলত লম্বা বাঁধ বা পিলার। যা শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তৈরি করা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন বন্যা থেকে বাঁচতে এই বাঁধ। এটি প্রায় ৭০ কিলোমিটার জুড়ে বৃস্তিত।

বেহুলা লখিন্দরের বাসর ঘর: স্থানীয়দের কাছে এটা গোকুল মেধ হিসেবেও পরিচিত। চাঁদ সওদাগর তার ছেলে লখিন্দরকে দেবী মনষার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য গোপন একটি ঘর তৈরি করেন। বেহুলা ও লখিন্দরের বিয়ের রাতে সেই ঘরে কঠোর নিরাপত্তা থাকা অবস্থায় মনষার পাঠানো সাপ দংশন করেন।

খোদার পাথর ভিটা: জানা যায় রাজা পশুরাম এই পাথরকে বলি দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতো। এটা দেখতে লম্বা ও আয়তাকার মসৃণ।

এছাড়ও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে মানকালীর টিবি, বৈরাগীর ভিটা, বিহার ধাপ, কালিদহ, জিয়ত কুণ্ড কূপ ইত্যাদি।

খনন ও পুনরুদ্ধার

১৯২৮-২৯ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার তৎকালীন মহাপরিচালক কাশীনাথ নারায়ন দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে প্রথম খননকাজ শুরু হয়। আর যেসব ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় তা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে মহাস্থান প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে। ১৯৬৭ সালে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ যাবৎ খনন কাজে পাওয়া যায় বৌদ্ধ ধর্মের দেব দেবতাদের মূর্তি, বিভিন্ন যুগের মুদ্রা, স্মারক লিপি, মাটির তৈজসপত্র, পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর, শিলালিপি, আত্নরক্ষার অস্ত্র, মূল্যবান অলংকার সামগ্রী সোনা, রুপা, লোহা, কাঁসা, তামাসহ বিভিন্ন ধাতব সামগ্রী। বর্তমানে মহাস্থান গড় প্রত্নতাত্ত্বিকের খনন কাজ চলমান রয়েছে। মহাস্থানগড় প্রাচীন নগরী হলেও এখন প্রায় জনমুখী হয়ে উঠেছে। পর্যটন শিল্প হিসেবে প্রতিদিন দেশ বিদেশের মানুষ এসে ভিড় করে ইতিহাসের বাস্তব চিত্র দেখতে।

যোগাযোগ

রাজধানী ঢাকা থেকে আসতে গেলে ট্রেন ও বাসে আসতে হবে। ঢাকা কল্যানপুর ও গাবতলি বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়ি সরাসরি বগুড়ার মেইন শহর সাথমাথায় আসা যায়। সেখান থেকে বাস, সিএনজি করে ১৩ কিলোমিটার দূরে এই মহাস্থানগড়। ট্রেনে আসতে গেলে কমলাপুর রেলস্টেশনে উঠে সরাসরি সান্তাহার জংশনে পৌঁছে, সেখান থেকে বগুড়ার ট্রেনে উঠতে হবে। এখন হেলিকপ্টারেও আসা যায় বগুড়াতে। ঢাকা থেকে মমইন হোটেলে হেলিকপ্টার এসে পৌঁছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন