ঢাকা | বৃহস্পতিবার
৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিলেটের অর্থনীতিতে বন্যার করাত

সিলেটের অর্থনীতিতে বন্যার করাত

ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ছে সিলেট বিভাগ। মাত্র ৩ মাসের ব্যবধানে ৩ বার বন্যার কবলে পড়তে হলো বিভাগের সিলেট ও সুনামগঞ্জকে। গত ১৫ জুন থেকে দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে পড়ে সিলেট। এবারে বন্যা শুরুর এক সপ্তাহ পর থেকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করলেও গত দুদিন থেকে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ফের বাড়ছে পানি। এ অবস্থায় বিধ্বস্ত সিলেটের অর্থনীতিতে যেন করাত চালিয়েছে ভয়াল বন্যা। দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় বড় সংকটে পড়ে গেছে সিলেটের অর্থনীতি। এসব বন্যায় বোরো আর আমন ফলন নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সবজি, মৎস্য, পর্যটনসহ নানা খাতে ব্যাপক লোকসান হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, বন্যার প্রভাবে এরই মধ্যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।

সিলেট চেম্বার ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে জেলায় প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা  লেনদেন হতো। ১৫ জুন থেকে সিলেট ফের বন্যাকবলিত হওয়ায় শহর থেকে গ্রাম প্রায় ৯০ ভাগ এলাকাই প্লাবিত হয়ে পড়ে। ফলে অনেক স্থানে এখন পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ থাকাসহ ব্যবসায়ীক লেনদেন এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। জেলার ৭০ শতাংশ হাটবাজার এখনো প্লাবিত। ফলে ব্যবসায়িক লেনদেন এসব এলাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, সিলেটে এখনো বন্যা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব হচ্ছে না। তবে প্রাথমিক হিসাবে এ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্ততঃ ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বন্যা শেষে হিসাব করলে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য।

সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আহসানুল আলম জানান, এবারের বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনসহ জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভা প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় জেলার প্রায় অর্ধ কোটি লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েন। জেলায় ৬১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৪ জন লোক আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত পাওয়া সরকারি হিসাবমতে- ভয়াবহ বন্যায় জেলার ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪০ হাজার ৯১টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এ তালিকায় সিটি করপোরেশনের হিসেব নেই।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা দুযোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি নির্মাণ বা মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের আবেদন জানানো হয়েছে।

জানা যায়, এর বাইরে অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ও আসবাবও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি, মৎস্য, জনস্বাস্থ্য, প্রাণিসম্পদ, ব্যবসাসহ নানা খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যা শেষ হলে জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করবে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী বলেন, ‘প্রাথমিক হিসাবমতে- নগরে হাজারখানেক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমরা প্রস্তুত করছি। এরপর তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে এবং পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হবে।’

এদিকে, জেলায় মৎস্য খাতে ৭০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং প্রাণিসম্পদ খাতে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৫০ টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা নির্ধারণ করতে পেরেছেন। এর বাইরে অন্য দপ্তরগুলো এখনো সেভাবে টাকার হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে পারেনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা জানান, জেলায় দ্বিতীয় দফা বন্যায় ২৯ হাজার ২৪৯ হেক্টর জমির আউশ ধান ও ১১ হাজার ৯৮০ হেক্টর সবজির খেত তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় ২ হাজার ২৬৯ হেক্টর বোরো জমির ধান তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব ধরনের কৃষিজাত পণ্যের খাতও।

সিলেট চেম্বার সূত্রে জানা গেছে, পর্যটনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে জেলায় কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, নগরের অন্তত ৬৫ কিলোমিটার সড়ক বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

টাকার হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ১৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইনামুল কবীর জানান, তাঁদের অধীনে থাকা সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ৬০ শতাংশই তলিয়ে গেছে।

অপরদিকে, জেলায় ২৭৮টি গ্রামীণ হাটবাজার রয়েছে। এর বাইরে সিলেট নগরসহ উপজেলা সদরেও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ হাটবাজারই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে যাওয়া হাটবাজারের মধ্যে এখনো শতাধিক বাজার পানিতে প্লাবিত বলে ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, বাজার তলিয়ে থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. তাহমিন আহমদ বলেন, সিলেট এমন মহাদুর্যোগে পড়বে সেটি কখনো ভাবিনি। দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় গ্রামীণ অনেক ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বন্যা শেষ হলে পুঁজির সংকটে তাঁরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপায় বের করে নিতে হবে। সংকট উত্তরণে ব্যাংকগুলো নানা খাতের ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে পারে।

সংবাদটি শেয়ার করুন