সব কিছুই ছিল স্বাভাবিক। প্রতিদিনের মতো বাড়ির কাজ করছি। গরুকে খাবার দিচ্ছিলাম। তখন বেলা ১২টা। শুরু হলো বৃষ্টি। দ্রুত ঘরে গিয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা চললো। কিন্তু থামছে না। যতই সময় যাচ্ছে বৃষ্টিও বাড়ছে। বৃষ্টির মতোই ঝরছে বজ্রপাত। চারিদিকে বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর শব্দ। ভয়ে চুপসে গেছি সবাই। কী হচ্ছে চারিদিকে? মনে হচ্ছিলো মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাড়ির সবাই।
ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। তবে চোখে ঘুম আসছে না। তুমুল বর্ষণের মধ্যে একাত সেকাত করে ঘোরের মধ্যে কেটে গেল গোটা রাত। সকালে বিছানা থেকে উঠলাম। তখনও ঝরছে অঝোর বৃষ্টি। ঘরের দরজা খুলতেই হতবাক হয়ে গেলাম। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। এ কি! চারিদিকে অথৈ পানি। ঘরের দরজা পর্যন্ত ঢেউ খেলছে পানি। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এমন কিছু যে দেখবো তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
অথচ আগের দিন বিকেলে বাড়ির উঠোন ছিলো খটখটে শুকনো। আর আজ পুরো বাড়ি জুড়ে ঢেউ খেলছে পানি। কোথা থেকে এলো এত পানি? কীভাবে ঘটলো এমন? আরেকটু হলেই ঘরে ঢুকে যাবে পানি। ঘরে বৃদ্ধ বাবা। কোথায় যাব তাদের নিয়ে? গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। হঠাৎ হুঁশ ফিরলো। পায়ের তালুতে শীতল স্পর্শ। নিচের দিকে তাকাতেই দেখি ঘরে পানি ঢুকে গেছে। অবিশ্বাস্য ঘটনা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘরে পানি বাড়তে লাগলো। হুহু করে বাড়ছে সেই পানি। একেবারেই দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা। পড়িমরি করে ছুটে গিয়ে বৃদ্ধ বাবার খাটটা একটু উঁচু করার চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে সবার মধ্যে ভয়, আতঙ্ক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। খাটের নিচে ইট বিছিয়ে কোনোরকমে উঁচু করা হলো। ততক্ষণে পানি উঠে গেছে হাঁটুর ওপরে।
ভয়ে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরে পানি বাড়ছে, আর বাইরে বজ্রপাতের তাণ্ডব। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার মতোও পরিস্থিতি নেই। কোথায় যাবো? কী করবো? বুঝে উঠতে পারছি না। এক খাটের ওপরে আরেক খাট বসিয়ে বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা। তাতেও যদি রক্ষা না হয় তাহলে বজ্রপাতের মধ্যেই ঘর ছাড়তে হবে। কোথাও কোনো উঁচু বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে উঠতে হবে। এভাবে কাটতে লাগলো অনেকটা সময়। এর মধ্যে পানি বাড়ছেই হুহু করে।
এবারে সিলেট বিভাগে হঠাৎ ধেয়ে আসা ভয়াবহ বন্যার প্রথমদিনের দুঃসহ স্মৃতি এভাবেই বর্ণনা করছিলেন হাওরের জেরা সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ ইউনিয়নের বাকগাঁও গ্রামের গোলাপ মিয়া। তিনি স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতিও। বাকগাঁ গ্রামটি হাওর বেষ্টিত। এমনিতেই গ্রামের বাসিন্দাদের পানিবন্দি থাকতে হয় বছরের ছয় মাস।
গোলাপ মিয়া দৈনিক আনন্দবাজারকে আরও বলেন, জীবনে এতো পানি আর কখনও দেখিনি। আমার বাবার বয়স একশ ছুঁইছুঁই। তিনিও এমন বন্যা দেখেননি কখনও। তিনি বলেন, সেই যে একরাতেই ধেয়ে আসা বন্যার তাণ্ডব ছিল সপ্তাহখানেকের মতো। এরপর পানি নামলো ঠিকই। তবে চারদিকে বন্যার ভয়াবহ ক্ষতচিহ্ন। ক্ষতির কথা আর বলে বোঝানো যাবে না। আমাকে নিঃস্ব করে গেছে। সব হারিয়ে ফেলেছি। ভেসে গেছে মাছের ঘের। ভেসে গেছে আট লাখ টাকার মাছ। জাল টানার কোনো সুযোগ ছিল না। চোখের সামনেই সব শেষ হয়ে গেল।
সেই দুঃসব স্মৃতি গোলাপ মিয়াকে আজও তাড়া করে। এলাকার মুরব্বি হিসেবে অন্য সবার খোঁজ নিয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আবারও বলেন, এলাকার মানুষের খোঁজখবর নিতে বৃষ্টি থামার পর আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে গেছি। সেখানে যা দেখলাম তা সহ্য হওয়ার মতো না। একজনের গায়ের উপর আরেকজন। সবার মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সবাই। ছুটে গেলাম দোকানে। কিন্তু সেখানেও কিছু নেই। অনেক খোঁজার পর এক দোকানের তালা খুলে সেখানে এক বস্তা মুড়ি পেয়েছি। কিন্তু দোকানদার দিতে নারাজ। তাকে অনেক বুঝিয়ে মুড়ির বস্তাটা নিলাম। সঙ্গে নিলাম বিস্কুট। ছুটে চললাম আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে মুড়ির বস্তা খালি হয়ে গেলো। বিস্কুটও শেষ।
সেই সময়ে পড়লাম আরেক বিপদে। সবাই আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করলো। হাতে-পায়ে ধরে খাবার চাইতে লাগলো। কিন্তু আমি অসহায়। কোথাও খাবার নেই। যা ছিলো সবই এনে দিয়েছি। কিন্তু কারোরই পেট ভরেনি। আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে আমার। তাদের কাছে ক্ষমা চাইলাম। এমন দিনে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারিনি বলে।
গোলাপ মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। যেন সেই দুঃসহ মুহূর্তগুলো তাকে তাড়া করছে। খানিকটা নীরব থাকার পর আবারও বলেন, এমনিতেই এই গ্রামে কেউ ত্রাণ দিতে আসে না। একবার একটি ত্রাণের ট্রলার এসেছিলো ৩০০ প্যাকেট নিয়ে। কিন্তু তারা ১২০ প্যাকেট দিয়েই চলে যায়। তাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা চলে গেছে। অথচ তারাই আমাকে দিয়ে ৩০০ লোকের তালিকা করিয়েছে। সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছি অথচ ত্রাণ দিতে পারিনি। পরে যাদের দিতে পারিনি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
একই গ্রামের পানিবন্দি অসহায় নারী মরজিনা বেগম। বাড়ির চারপাশেই পানি। জং ধরা একচালা টিনের ঘর। ছোট্ট ঘরটিতে জায়গা অনেক কম। কোনোরকম ছোট্ট একটি চকি বিছানো। পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে থাকেন এই ঘরেই। সেখানেই থাকা আর খাওয়া। ব্যবস্থা নেই স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশনের। ঘরের চারপাশে ময়লায় পূর্ণ। ভেতরে প্রচুর পিঁপড়া। দাঁড়ানোর কোনো উপায় নেই। কোনোরকম পার করছেন জীবন। প্রতিনিয়তই তাকিয়ে থাকেন দূরপানে। অপেক্ষা করতে থাকেন ত্রাণের জন্য। তবে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। কেউ ত্রাণ নিয়েও আসে না। এলাকাটি যে ভারত সীমান্তে। বেহাল সড়ক আর হাওরের শেষ প্রান্তে হওয়ায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়াও সম্ভব না। তাই তো খেয়ে না খেয়েই কাটছে সময়।
মরজিনা বেগম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ‘ফানি আওয়ার পরে আমরারে কেউ দেখাত আইসে না। ছুটক গরো ফঙ্গু জামাই লইয়া আছি। গর অর্ধেক ডুবি গেছিল। ফানির লাগি গরো থাখতাম পারছি না। অখন ফানি তোরা কমছে। তবুও ফুক, ফিফড়ার যন্ত্রণায় গরো গিয়া বওয়াও যায় না। সব মানুষ মেইন রোডর খান্দাবায় ত্রাণ দের। আমরা বিতরে থাকায় আমরার ইবায় কেউ আয়ও না। আমরার নৌকাও নাই, যে গিয়া আনতাম। খাইয়া না খাইয়া খুব কষ্টে আছি। ফারলে আমরার লাগি কিছু ব্যবস্থা করো’।
বাকগাঁও গ্রামের আরেক বাসিন্দা সিরাজ মিয়া। বন্যার পানিতে তার ঘরও তলিয়ে গেছে। ঘর অর্ধেকই ছিলো পানির নিচে। কাজ হারিয়ে এখন নিঃস্ব। সিরাজ মিয়া বলেন, খেতো ধান করছিলাম। ধান ফাক ধরার পরও কাটছিলাম। কিন্তু বন্যার ফানির লাগি কিছু করতাম ফারছি না। সব ধান অখন ফানির নিছে। ৫০ বস্তা ধান ফানিতে। সব ফছি গেছে। আমরার সব শেষ। গরত কিছু নাই। অখন কিতা করতাম। কিছু করতাম পারছি না। খাইতামও পারছি না। কেউ আমরারে ত্রাণও দের না। ফানি বেশি থাকায় কেউ ইবায় আয়ও না। খাইয়া না খাইয়া আছি। আমরার লাগি সরকারও কিছু করছে না। ফারলে আমরার লাগি কিছু করো ফুতাইন’।
দূর থেকে একটি ঘর দেখা যাচ্ছিলো। আশপাশে পানি আর পানি। মাঝখানেই এ ঘরটির অবস্থান। কাছে যেতেই দেখি ঘরের একটা অংশ কাঠি দিয়ে বাঁধানো। উপরের অংশ মাটির দেয়াল। কাঠির ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরের অংশ দেখা যাচ্ছিলো। এমন অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঘরের বাসিন্দা আবদুল গনি বলেন, কাঠির ওপর দিয়ে মাটি ছিলো। পুরো ঘরটাই ছিলো মাটির। পানি যতটুকু পর্যন্ত উঠেছে ততটুকুর মাটি সরে গেছে। ভয় নিয়ে ঘরে থাকি। কখন কি ডুকে যায় ফাঁক দিয়ে। যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে ঘর। আজকে অনেকদিন ধরে ঘরবন্দি। কোনো কাজ করতে পারছি না। ঘর থেকে বেরও হতে পারছি না। যা ছিলো সব নিয়ে গেছে বন্যায়। ধান কেটে গোলায় তুলছিলাম কিছু, কিন্তু সেগুলোও পচে গেছে। এখন পানি কমলে রোধে শুকিয়ে খাবো। পচা ধানের চাল খেয়ে বাঁচতে হবে। কেউ আমাদেরকে ত্রাণ দেয় না। আমরা অসহায়।
সুনামগঞ্জ থেকে যে সড়কটি চলে গেছে আলিপুরের দিকে তাকে সুনামগঞ্জ-আলীপুর সড়ক বলা হয়। এ সড়কের দু’পাশ ঘিরে মানুষের কর্মব্যস্ততা। সবাই পচা খড় রোধে দিচ্ছেন। প্রতিটি খড়ের স্তূপের বিতরে রয়েছে ধান। ধান কেটে আর ছাঁটাই করার সময়টুকু পাননি তারা। খড়সহ ধান চলে গেছে পানির নিচে। যে যেভাবে পারছে সেগুলো তুলে রোধে শুকাচ্ছে। পানির নিচে থেকে ধান হয়ে গেছে কালো। বের হচ্ছে বিদঘুঁটে গন্ধ। একেবারেই খাবার অনুপযোগী। তবুও সেগুলোর পেছনে শ্রম দিচ্ছেন সবাই। শুকানের চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া যে আর তাদের কোনো উপায় নেই। বেঁচে থাকার শেষ সম্ভল তো এইটুকুই।
সড়কে পচা থান শুকাচ্ছিলেন রইস মিয়া। তার সঙ্গে কথা হয় দৈনিক আনন্দবাজারের। তিনি বলেন, হঠাৎ করে বন্যার পানিতে সবকিছু তলিয়ে যায়। কখনো ভাবতেই পারিনি এতো পানি উঠবে। টাকা ২৮ ঘণ্টা বৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানিও যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। কিছু বুঝে উঠার আগেই সবকিছু তলিয়ে গেছে। গোলায় যে কয়টা ধান তুলেছি সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পচা ধান শুকানোর চেষ্টা করছি। খেয়ে তো বেঁচে থাকতে হবে। পেটে যখন ক্ষুধা থাকে তখন পচা খাবারও অনেক মজার হয়।
সিলেটের চৌহাট্টা এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সিলেট শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গা বলা হয় আলিয়া মাদ্রাসার মাঠকে। তবে সেখানেও পানি উঠে গেছে। কোমর পর্যন্ত পানি হয়েছে এখানে। আমরা সবাই খুব বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাবাও কখনো এখানে পানি উঠতে দেখেনি। এখানে পানি ওঠা মানে পুরো শহর পানির নিচে। এখানে কোমর পানি মানে শহরের অন্যান্য এলাকায় গলা পানির ওপরে। সিলেট থেকে কোথাও বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। শহরের অধিকাংশ মানুষই মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন।
আনন্দবাজার/শহক