ঢাকা | রবিবার
১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছোবাবাণিজ্যে ভাগ্যবদল রূপগঞ্জে

ছোবাবাণিজ্যে ভাগ্যবদল রূপগঞ্জে

অন্ধ বাবার বড় সন্তান। মা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। ঘরে ছোট দু’বোন, এক ভাই। সংসারের ঘানি টানা আর লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব ছিলো না পনের বছর বয়সের আনিকার। পাশের বাড়ির চাচির কথামতো হাতে তুলে নেয় কুরশি কাঁটা আর রঙিন সূতা। সেই যে শুরু। বাঁচার তাগিদে আজও কুরশি কাঁটা আর সূতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে আনিকা। কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি রঙিন ছোবা বানিয়ে নিজের জীবন, ছোট ভাই- বোনদের জীবন আর সংসারকে রঙিন করে তুলেছে।

কলেজ শিক্ষার্থী আনিকা সুলতানার মতো রূপগঞ্জের আরো ২০ হাজার নারী ছোবা বানিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। রঙিন ছোবায় জীবন হয়ে পড়েছে রঙিন। আনিকার নিপুণ হাতের তৈরি ছোবা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিমাসে রূপগঞ্জ থেকে প্রায় ১৬ কোটি টাকার ছোবা মহাজনদের মাধ্যমে রাজধানীর চকবাজারে যায়। যা বছরে প্রায় ১৯২ কোটি টাকার ধুন্ধুমার বাণিজ্য।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার নারীরা ছোবা তৈরি করে তাদের আয়ের পথ তৈরি করছেন। গ্রামে-গ্রামে এখন ছোবা তৈরির কাজ চলে। গ্রামের একেকটা ঘর যেনো ছোবা তৈরির কারখানা। নারী ও মেয়েরা এ কাজে জড়িত। রূপগঞ্জে ৪০ হাজার নারী কারিগর রয়েছে এ শিল্পে। নারীদের তৈরি করা এসব ছোবা মহাজনদের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার চকবাজারে পাইকারি বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে সারাদেশে এমনকি দেশের বাইরেও যাচ্ছে এখানকার তৈরি ছোবা।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন, রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, দাউদপুর ইউনিয়ন, ভোলাব ইউনিয়নের ঘরে-ঘরে নারীরা ছোবা তৈরি করছেন। একেকটি এলাকা যেনো একেকটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। অনেকটা নীরবে-নিভৃতে চলছে ছোবা বাণিজ্যের প্রসার।

ফাতেমা বিবি। স্বামী সুজন মিয়া অটোচালক। ঘরে এক সন্তান। তিনজনের সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে সুজন মিয়া হিমশিম খান। তাই স্বামীর পাশে দাঁড়ান ফাতেমা বিবি। কিন্তু করবেনটা কি এ ভেবে দিশেহারা। লেখাপড়াতো তেমন করা হয়নি। খুঁজতে-খুঁজতে পেয়ে গেলেন ছোবা বানানোর কাজ। প্রথম-প্রথম একটু-আধটু কষ্ট হতো। এখন তিনি সাংসারিক কাজ সেরে দিনে ১৫ থেকে ২০টা ছোবা বানান। মাসে প্রায় ৮০ টা। একেকটা ছোবা ৬ টাকা দরে প্রায় ২৫০০ টাকা আয় করেন।

ফাতেমা বিবি বলেন, সংসারের ফাঁকে ফাঁকে ছোবা বানাই। আজাইরা বইয়া না থাইক্যা যা আহে পোলাপানগো সংসার খরচাতো অয়। ফাতেমা বিবির শ্বাশুড়ি সাহারা বেগম। স্বামী আজিজ মিয়া মারা গেছেন প্রায় ১৯ বছর আগে। সাহারা বেগমের বয়স প্রায় ৬০। জীবনের শেষ সময়ে এসেও দমে যাননি তিনি। তিনি প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ টা ছোবা বানান। সাহারা বেগম বলেন, সোয়ামি নাই। পোলারা খাওয়ায়। হেরপরে আজাইরা বইয়া না থাইক্যা ছোবা বানাইয়া যা পাই নাতী-নাতকুরগোতো মজা-গজা খাইবার দিবার পারি। এইডাই শান্তি।

ফাতেমা বিবি, সাহারা বেগমের মতো নগরপাড়া এলাকার মাহমুদা আক্তার, মুক্তা বেগম, ঝুমা আক্তার সবাই ছোবা বানানোর কাজে মশগুল। সবাই দলবেঁধে বসে ছোবা বানাচ্ছিলো। এরা সবাই সংসারের কাজের ফাঁকে ছোবা বানিয়ে অনেকটা স্বচ্ছল হয়েছেন। অনেকে ছোবা বানানোর অতিরিক্ত আয়ের টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখছেন।

এতো গেলো কেবল ছোবা তৈরির কারিগদের জীবনের গল্প। ছোবার মহাজনদের পেছনের গল্পও কিন্তু অদ্ভুদ। তেমনি একজন নগরপাড়া এলাকার নিলুফা বেগম। দরিদ্র বাবার বোঝা হওয়ায় ১২ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের পর স্বামী শফিকুল ইসলামের ইছাখালী গ্রামে থাকতেন তারা। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। রাজনীতি আর অসৎ সঙ্গের কারণে ভিটেহারা হয়ে যায় তারা। গত ৫ বছর আগে খামারপাড়া (বাগ) বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেও বেশিদিন ঠাঁই মেলেনি।

পরে পাশের গ্রামের রব মিয়ার বাড়িতে ভাড়ায় বাসা নেন। সেখান থেকে শুরু করেন ছোবা বানানো। কারিগর হিসাবে বেশিদিন থাকতে হয়নি তাকে। গ্রামের সমিতি থেকে ৩০০০ টাকা লোন নিয়ে নিজেই ছোবার ব্যবসায় নেমে পড়েন। এখন নগরপাড়া, দেইলপাড়া, দক্ষিণপাড়া, নয়ামাটি, ইছাখালী, বরালু, ছাইতান এলাকায় তার বিশাল ময়াল। তার অধীনেই এখন কাজ করেন ১৬০ জন কারিগর। এখন ব্যবসায় তার দেড় লাখ টাকার মূলধন রয়েছে। নিলুফা বেগম বলেন, জীবনে অনেক কষ্ট করছি।

সময়তে খাওয়ন না থাহায় পোলাপানরে গরম পানি জ্বাল দিয়া খাইয়াইছি। আল্লায় অহন একটু সুখ দিছে। প্রতি হপ্তায় খরচ যাইয়া ৭/৮ হাজার টেকা থাহে। এক বছর গেলে আশায় আছি জায়গা কিনুম। নিজে লেহাপড়া করবার পারি নাই। একটা পোলা, একটা মাইয়া। দুইজনরেই লেহাপড়া করাইতাছি। ওগো মানুষ করবার বড়ই ইচ্ছা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জে প্রায় ১৫০ জন মহাজন রয়েছে। তবে নারী মহাজন শুধু নিলুফার বেগম। নিলুফা বেগমের মতো বরুনা এলাকার রব মিয়া, আলাল, দুলাল রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের মনির মাঝিনা নদীর পাড়ের গোলজার, ফারুক হোসেন, দেলোয়ার ইছাখালী এলাকার বারেকের কারিগর রয়েছে জনপ্রতি ২শ’ থেকে আড়াইশ।

মহাজন রব মিয়া বলেন, মহাজনরা চকবাজারের সৈয়দপুর ষ্টোর থেকে সুতা কিনে কারিগরদের দেন। এক কেজি রন সুতার দাম ২৭০ টাকা। আর সাদা সুতার দাম ২৪০ টাকা। মহাজন গোলজার হোসেন বলেন, ছোবার ব্যবসা সারা বছরই চলে। তবে চৈত্র থেকে ভাদ্র মাস (গরমকাল) এ ৬ মাস ধুন্ধুমার বাণিজ্য। মহাজন বারেক মিয়া বলেন, চকবাজারের হাজী কাজল স্টোর, শাহীন স্টোর, রাব্বি স্টোর, সারোয়ার স্টোরের মালিকরা এসব ছোবা কিনে রাখেন। এখান থেকে সারাদেশে এমনকি বিদেশেও যায় এ ছোবা।

কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাসুম আহম্মেদ বলেন, গ্রামের এসব নারীরা সংসারের কাজের ফাঁকে ছোবা বানিয়ে আয়ের পথ তৈরি করেছে। পাশাপাশি অলস সময় কেটে যাচ্ছে।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ নুসরাত জাহান বলেন, আমার জানা ছিলো না এ উপজেলায় নীরবে এতো বড় নিপুণ কাজ হয়। আসলেই অবাক করার বিষয়। নারীদের হাতে এতো টাকা আয় হয়। আমি চেষ্টা করবো তাদের পাশে দাঁড়াতে, সহযোগিতা করতে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন