ইলিশের অভয়াশ্রমের আশেপাশের বড় বড় প্রকল্প, নদ-নদীতে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারে ইলিশ কমছে
–মীর মোহাম্মাদ আলী, সহকারী অধ্যাপক, ফিশারিজ, অ্যাকোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদ. শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
চলছে ইলিশের মৌসুম। তবে উপকূলের নদ-নদীতে মিলছে না আশানুরূপ ইলিশের দেখা। জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই ইলিশের মৌসুম শুরু হয়। অথছ জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে আষাঢ় এলেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না রুপালি ইলিশ। শুধু চলতি বছরেই নয় গত দুতিন বছর ধরে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর নদ-নদীতে এ সময়ে ইলিশ মিলছে না।
জেলেরা জানান, মৌসুমের শুরু থেকে উপকূলীয় নদ-নদীতে ইলিশের হাহাকার চলছে। জাল ফেলে ইলিশ না পেয়ে খালি হাতে ফিরছেন তারা। উঠছে না যাওয়া-আসার জ্বালানি খরচও। তাই হতাশায় দিন কাটছে জেলেদের। এনজিওর ঋণ, মহাজোনের দাদন এবং ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ছেন।
এদিকে, মৎস্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের চলাচল পথ এবং জীবনচক্রে অল্পস্বল্প প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করার কারণে দিনদিন নদ-নদীতে ইলিশ কমছে।
তবে মৎস্য বিভাগের দাবি, ইলিশ মৌসুম কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে খুব শিগগরই জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়বে বলে মনে করছেন তারা। জ্যৈষ্ঠতে মৌসুম শুরু এই শুরুতেও ইলিশ না পেয়ে আষাঢ়ে ইলিশের দেখা মিলবে এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন জেলেরা। ভেবেছেন আষাঢ়ে ঘুচবে তাদের দুঃখ। জালে ধরা পড়বে মাছ। কিন্তু জেলেদের সেই আশাও পূরণ হয়নি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার আগুনমুখা, বুড়াগৌরাঙ্গ, রাবনাবাদ ও দাড়ছিড়া নদীতে ইলিশ একেবারেই কম ধরা পড়ছে। দেখা মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশের। এ পরিস্থিতিতে নদীতে যাওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন জেলেরা। চরমোন্তাজ, চালিতাবুনিয়া, মৌডুবি, কোড়ালিয়া, নিজকাটাসহ মৎস্য আহরণের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলেদের অনেকেই নৌকা-ট্রলার নিয়ে ঘাটে অলস সময় পার করছেন। ইলিশ না পেয়ে জেলে পরিবারগুলোতে ঋণের বোঝা বাড়ছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের জেলে সুমন মিয়া বলেন, ‘জাইল্ল্যারা (জেলে) এইবার শ্যাষ। নদীতে কোনো মাছ নাই। হারাদিন (সারাদিন) জাল হালাইয়া (ফেলে) রাখলেও একটা মাছ পাওয়া যায় না। সাগরে কিছু মাছ আছে, কিন্তু নদীতে কোনো মাছই নাই। জাইল্ল্যাগো বাঁচার কোনো উপায় নাই। চাউল-পাতের যা দাম। কোনো আয় নাই। শুধু দেনা ওয় (হয়) জাইল্ল্যারা।
মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, গেল দুই-তিন বছর ধরে উপকূলের এ চারটি নদীতে ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে। অথচ একসময় এসব নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে মাস পাওয়া যেত এই সময়ে। এবারের অবস্থা আরও খারাপ। মাছ নেই বললেই চলে। তাই হাট-বাজারগুলোতে ইলিশ পাওয়া কষ্টকর। দামও নাগালের বাহিরে।
চরমোন্তাজ বউবাজারে অবস্থিত মায়ের দোয়া মৎস্য আড়তের পরিচালক হাবিব মিয়া বলেন, ভাই জেলেদের কষ্টের কোনো শেষ নাই। গত কয়েক বছর ধরে নদীতে কোনো মাছ নাই। গত দু’বছর কিছু টুকটাক পাওয়া গেলেও এবার কোনো মাছই পাওয়া যাচ্ছে না। জেলেরা খুব কষ্টে আছে। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে।’ তিনি বলেন, এইসময়ে আড়তে অনেক মাছ আসতো। এখন দেখেন, কোনো মাছ নাই।
জেলেদের ভাষ্যমতে, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে কয়েক ধাপে ১৪৭ দিন ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে হাজারও জেলের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। জেলেরা সরকারি যে চাল পায়, তাও অপ্রতুল। অনেকেও তাও পান না। ফলে তাদের জীবন কাটে চরম দুর্দশায়। এরমধ্যে এখন নদ-নদীতেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে জেলেদের দুঃখ-কষ্ট যেন শেষই হচ্ছে না।
এবিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বাবুল জানান, ‘প্রজননকালীন সময়ে ইলিশ সাগরে অবস্থান করে এবং মৌসুম কিছুটা পরিবর্তন হওয়ায় নদ-নদীতেও ইলিশ কম ধরা পড়ছে। তারা আশা করছেন, বৃষ্টিবর্ষা শুরু হলেই শিগগরই নদ-নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছের দেখা মিলবে।
এ ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মাদ আলী জানান, আমাদের উপকূলীয় এসব নদীগুলো ইলিশ ধরার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু আন্ধারমানিক নদীসহ তার আশেপাশের জায়গাগুলোতে যেভাবে বড় বড় প্রকল্প শুরু হয়েছে, বিদ্যুতের প্রকল্পগুলো সব ইলিশ অভয়াশ্রমের আশেপাশে। নদ-নদীতে অবাধে বিভিন্ন নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার হচ্ছে। এসব কারণে ইলিশ কমছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দিনদিন আরও কমবে ইলিশ। হুমকিতে পড়বে জেলেদের জীবন ও জীবিকা।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে রাঙ্গাবালীতে নিবন্ধিত জেলে সংখ্যা ১২ হাজার ৮২০ জন। কিন্তু জেলেদের দাবি, প্রকৃত পক্ষে মাছ শিকারের ওপর নির্ভর জেলে সংখ্যা এখানে ২০ হাজারেরও বেশি।
আনন্দবাজার/শহক