ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রস্তাবিত বাজেটটি তদবিরের: ডা. জাফরুল্লাহ

প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটকে তদবিরের বাজেট বলে আখ্যায়িত করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটটি তদবিরের বাজেট। যারা বিভিন্ন ধরনের তদবির করেছে তাদের জন্য বাজেট ভালো হয়েছে। লেনদেনটা টেবিলের নিচে দিয়ে করলে তাদের জন্য ভালো। এই ধরনের বাজেট। কেননা বাজেটে ট্যারিফের যে কয়েকটি বই আছে সেটিই আসল। অথচ এসব বই এখনো অনেকে পায়নি। সেখানেই মূল চালাকিটা। শুল্কের ৮টি স্তর করা হয়েছে। এটি তদবির ও বড় লোকের বাজেট। রপ্তানিকারকরা আগে শুন্য দশমিক ৫ শতাংশ কর দিতেন তা এখন শুন্য দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে, এটি ভালো দিক। বাকি সবখাত ভুল সিদ্ধান্ত।

শুক্রবার মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩: স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক পর্যালোচনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন।
সংগঠনের ফরেস্ট, এনভাইরনমেন্ট, টুরিজম, এনিম্যাল এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্চ অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি রঞ্জিত কুমার বর্মনের সঞ্চালনায় ও স্টামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ, হেলথ এন্ড হোপ স্পেশালাইজড হাতপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হাসান সোহেল ও ঢাকা পোস্টের জেষ্ঠ প্রতিবেদক আবদুর রহমান মাসুম প্রমুখ।

পাচার করা অর্থ বৈধতার সুযোগ বিষয়ে প্রবীণ এই চিকিৎসক বলেন, সাড়ে ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে আমার টাকা দিয়ে বিদেশে নিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে। সেই দেশের সরকার যখন প্রশ্ন করেছে এ টাকা কোথায় পেলে? তখন সার্টিফিকেটের জন্য এই কাজ করা হয়েছে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সাড়ে ৬ কোটি শ্রমিকের জন্য বাজেটে কিছু নেই। ঈদে তাদের মুখে হাসি ফুটবে না। গত দুইবছর যাবত আর্মিদের সূলভমূল্যে রেশনের মতো শ্রমিকদেরও দেন। ফ্রি নয় টাকাতেই দেন। পাঁচশ টাকা করে দিন, তাতে শ্রমিক একশ ও মালিক চারশ ও সরকার কিছু টাকা দিক। শ্রমিকদের সন্তানদের বিনা পয়সায় স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেন। তা হলে নোবেল প্রধানমন্ত্রীর পেছনে ঘুরবে। বাসের ভাড়া অর্ধেক করে দিন।

তিনি বলেন, ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ২০ টাকার শ^াস কষ্টের সিরিজ ২৭০টাকা হয়ে গেছে। এখন রুগ্ন মেডিকেল কলেজ তৈরি করা হচ্ছে। নার্সিং, ফিজিওথেরাপির জন্য আলাদা কলেজ ইত্যাদি। আমলারা একদিকে। আর বাকিরা একদিকে। প্রশিক্ষিত ডাক্তার প্রয়োজন। ৪ কোটি টাকায় ল্যাবরেটরি করা যায়। কাজগুলো আনন্দদায়ক করতে হবে। সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা কয়েক জায়গায় খেপ মারে। অথচ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকদের ট্যাক্স ধরেছেন এটা ঠিক না। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ৩৪ হাজার টাকার বেক্সিকো ৩৪ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। দেশের রোগব্যাধী বাড়ে আকাশ ছুঁইছে। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি বাস্তবায়ন না করলে দেশের স্বাস্থ্যসেবাখাত ঠিক হবে না। বিল্ডিং মানেই স্বাস্থ্যসেবা নয়।

তিনি বলেন, সরকারকে সামনের দিকে তাকাতে হবে। আগামী ২০ বছর কি হবে তা চিন্তা করতে হবে। তখন মানুষ হবে ২৫ কোটি। সরকারি ভাষ্যমতে ৪ কোটি মানুষের ৬০ বছরের ওপরে। বয়স্ক লোকদের সেবা করাবে কে?

আটশ পৃষ্ঠার বইয়ের মধ্যে ১৩ পৃষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার নিয়ে। তিনি ভালো কাজ করছেন তার প্রশংসা থাকবে এটি ভালো দিক।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, পরিবেশ ভালো হয়ে গেলে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় কম হবে। কেননা পরিবেশগত রোগবালাই বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা পানি, বায়ু, খাদ্য, বর্জ্যব্যবস্থাপনাতে হুমকির মুখে পড়েছি। এ সমস্যা সমাধানে বর্তমান বাজেট অপ্রতুল বরং আরো কয়েকগুণ বাজেট প্রয়োজন পরিবেশখাতে।
অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বর্তমানে বিশে^ ভ্যাবারেজ ও বিসমার্ক মডেলে স¦াস্থ্যখাত চলছে। ভ্যাবারেজ মডেলটি যুক্তরাজ্যের। এটি জনগণ থেকে সরকার ট্যাক্স নিয়ে জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়। অপরটি বিসমার্ক মডেল। যা জার্মানিতে শুরু হয়। বাংলাদেশে ভ্যাবারেজ মডেলে চলে। আর এখন মূলত বিশে^ চলে বিসমার্ক মডেলে।

তিনি বলেন, ২০১২ সালের স্বাস্থ্যনীতিমালা যা করা হয়েছে তাতে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক তেমন কিছু বলা হয়নি। এজন্য যুগোপযুগী একটি নীতিমালা প্রয়োজন।

স্বাস্থ্যবিমা সম্পর্কে সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্যবিমা বলতে সাধারণত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সব জনগণের জন্য চলবে। সরকারি চাকরিজীবী ১৩ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে প্রিমিয়াম বেতন থেকে নেয়া ও ৮৭ শতাংশ জনগণের অর্থ সরকার দিবে। তহবিল সমস্যার সমাধান হচ্ছে- সাড়ে ১৮ হাজার কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ১০ টাকা করে নিয়ে আর সরকার কিছু দিলে ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে। হেলথ ইকুইটি ফান্ড করা যেতে পারে। সমাজকল্যাণ ফান্ডও ব্যবহার করা সম্ভব।

তিনি বলেন, সব জায়গায় স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে হবে। কেননা সরকার স্বাস্থ্যখাতে ফাইনান্সিয়াল অটনমি নিতে চায় না। সরকারি হাসপাতালে নিয়ম পরিবর্তন না হলে স্বাস্থ্যবিমা সম্ভব নয়।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যসেবাকে চিকিৎসাতে পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা মূলত রোগের হয়। আর স্বাস্থ্যসেবা মূলত পুরো জাতির সুস্থ্য মানবিক বিকাশ।
তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষ সেবা নেয় কিন্তু তাদের জন্য বাজেটে কিছুই নেই। সরকারি-বেসরকারি হাসপতালের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। একে বিকশিত করতে দেখতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটটি হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা, সামান্য ওষুধপাতি দিয়ে চালিয়ে নিতে। অথচ ৮০-৮৩ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে থেকে করা হয়। অর্থাৎ সরকার ইচ্ছা করেই বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাষ্ট্রের বাজেটটি জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা বাজেট করতে হবে।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে শুরু সরকারি হাসপাতালের জন্য করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তামাক, স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সিএসআরের ৫০ শতাংশ, মোবাইল থেকেসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ নেয়া নিতে হেব। এসব ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা যুক্ত করে স্বাস্থ্যবিমায় প্রিমিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

মাঈনুল হাসান সোহেল বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সচিব ও অন্যান্য নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে ডাক্তারদের থেকে নিয়োগ দেয়া দরকার। আর ব্যয়ের দিকে সঠিক পরিকল্পনাও দেখা যায় না।

আবদুর রহমান মাসুম প্রশ্ন রাখেন স্বাস্থ্যখাত আসলে কার? এই প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার চেয়ে বিল্ডিং ও অবকাঠামো নির্মাণ ও টেকনিক্যাল পণ্য কিনতেই এখানে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। তাতে করে দুর্নীতিও প্রচুর বৃদ্ধি পায়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন