প্রাকৃতিক বৈরিতা, ঝড়-বন্যার মৌসুম শুরু হওয়ায় উৎকণ্ঠা বাড়ছে ভোলার চরফ্যাশনের জেলেদের। সঙ্গে জলডাকাতের আতঙ্ক রয়েছেই। নদী ও সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে প্রতিবছর অনেক জেলে নিখোঁজ হন। তাদের কারও কারও লাশ ফিরে আসে পরিবারের কাছে। আবার অনেকের কোনো খোঁজ পায় না জেলে পরিবারগুলো। নিখোঁজ জেলেদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন স্বজনেরা। তাই প্রতিবছর দুর্যোগ মৌসুম শুরু হলেই জেলে পরিবারে স্বজনদের কান্না বেড়ে যায়।
সাগর উপকূলীয় অঞ্চলে জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত দুর্যোগ মৌসুম। আর এ মৌসুমে উপকূলবাসী বন্যা, জলোচ্ছ্বাস আতঙ্ক থাকেন। এতে নদী, সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের নিয়ে হারানোর ভয় কাজ করে স্বজনদের। হাজারীগঞ্জ এলাকার জেলে জাফর মাঝি বলেন, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে দুই ধরনের বিপদের মুখে পড়তে হয় জেলেদের। জলডাকাতদের কবলে পড়ে নিঃস্ব ও ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ হন জেলেরা।
চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্যমতে, উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছেন। নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৪ হাজার ২৮১ জন। অনিবন্ধিত জেলে প্রায় ৪৬ হাজার। এসব জেলে নদী ও সাগরে মাছ শিকার করেন। প্রায় ১২ হাজার ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রগামী ৭ হাজার ট্রলার রয়েছে। এসব জেলেদের মধ্যে ২০১৫ সালে ১১, ২০১৬ সালে ১৯, ২০১৭ সালে ৫, ২০১৯ সালে ৪৮, ২০২০ সালে ৯ এবং ২০২১ সালে ৯ জেলে নদী ও সাগরে নৌকা ডুবে প্রাণ হারান।
২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারানো জেলে পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানের চেক দেওয়া হয়। তবে ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ও ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ ২২ জেলে পরিবার ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানের চেক পেলেও ৪৪ জেলের পরিবার এখনো কিছুই পাননি।
চরফ্যাশন উপজেলায় ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৬ জেলে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ও ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হন। নিখোঁজ জেলেদের অধিকাংশ লাশ পান স্বজনেরা। বাকিদের খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ জেলেরা চর মাদ্রাজ, আসলামপুর, মাদ্রাজ, জিন্নাগড়, আমিনাবাদ, আবুবকরপুর, আহম্মদপুর, ওসমানগঞ্জ, এওয়াজপুর, হাজারিগঞ্জ, জাহানপুর, রসূলপুর, চর মনিকা, চর কুকরি মুকরি, চরপাতিলা, নজরুলনগর, মুজিবনগর, ঢালচর, নুরাবাদ, নীলকমল, আব্দুল্লাহপুর, চরকলমী এলাকার।
নুরাবাদ এলাকার জামাল (৩৭) ২০১৯ সালের ১২ জুলাই সাগরে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন। তার বাবা জাকির হোসেন বলেন, সংসারের অভাব দূর করতে ছেলেটা দিন-রাত সাগরে পড়ে থাকত। কূলে ফেরার দুই দিন আগেই আকস্মিক ঝড়ে তাদের ট্রলার ডুবে যায়। সেদিন ট্রলারে থাকা অন্য জেলেরা বেঁচে ফিরলেও আমার ছেলেসহ দুজন নিখোঁজ হয়।
ঢালচর মৎস্য ঘাটের আড়তদার আব্দুস সালাম বলেন, ঢালচর এলাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দা জেলে। এ এলাকার ১ হাজার ৬০০ জেলে নদী ও সাগরে মাছ শিকার করেন। এখানকার জেলেরা মাছের আড়তদারদের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়ে নৌকা তৈরি করেন। এমনকি জাল থেকে শুরু করে চাল-ডাল কিনে দিতে হয় জেলেদের। ভাগ্য খারাপ হলে অনেকেই ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাসহ নিখোঁজ হন। এতে হারাতে হয় দাদনের লাখ লাখ টাকা।
চর কুকরি-মুকরি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন বলেন, এ ইউনিয়নে প্রায় ১ হাজার ২০০ জেলে দুর্যোগের সময়ও নদী ও সাগরে ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করেন। ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাসহ অনেক জেলে নিখোঁজ হন।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার বলেন, শুরু হয়েছে দুর্যোগের মৌসুম। এতে উপকূলীয় এলাকায় জেলে পরিবারগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে আতঙ্ক। চরফ্যাশন উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছেন। এসব জেলেরা নদী ও সাগরে মাছ শিকার করেন দুর্যোগের সময়ও। ঝুঁকি এড়াতে জেলেদের মধ্যে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী লাইফ জ্যাকেট বিতরণসহ সর্তকতামূলক পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
আনন্দবাজার/শহক