নৌকায় বসবাস করা বেদে কন্যাটির নাম নূরজাহান। বয়স ১২ বছর। ওর বয়স যখন ৪ মাস তখন ঘুমন্ত অবস্থায় নৌকার ছাউনিতে লাগানো কপি’র আগুনে পলিথিন পুড়ে পায়ে পড়ে। এরপর পরিবারের গাফেলতি আর যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মেয়েটি পা নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যায়। যে কারণে তাকে কটাক্ষ করে সবাই ‘ল্যাংড়ি’ নামে ডাকতে শুরু করে। চাঁদপুর নুতনবাজার-পুরানবাজার সংযোগ সেতুর নিচে প্রায় ৭০ বছর ধরে বসবাসকারী ১০০ বেদে পরিবারের সবাই মেয়েটিকে এই নামেই ডাকে।
মেয়েটির নানা বলেন, আগুনে পোড়ার পর বাবা তার মা এবং তাকে ছেড়ে অন্য একজন নারীকে বিয়ে করে সংসার পাতেন। তাতে পরিবারের মধ্যে ভাঙন ধরে। এক পর্যায়ের মেয়েটির নানা তার মাকেও অন্যত্রে বিয়ে দিয়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে নানা ও দাদার তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকে নূরজাহান। সেই সাথে বড় হতে থাকে দূর্ভাগ্যও।
তবে নূরজাহানের দুর্দশা চোখে পড়ে চাঁদপুরের স্থানীয় সাংবাদিক রিয়াজ শাওনের। ফোরামের সভাপতি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মিজান মালিকের নেতৃত্বে মেয়েটিকে চিকিৎসা করানোর জন্য অনুরোধ জানা তিনি। এরপরই বদলে যেতে থাকে গল্প।
ফোরামের সদস্য সাঈদ আল হাসান শিমুল মেয়েটির দুর্দশার কথা সাধারণ সম্পাদক রাশেদ শাহরিয়ার পলাশকে জানান। এরপরই ফোরামের মিটিংয়ে আলোচনা করে মেয়েটিকে চিকিৎসা করানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফোরামের সদস্য শাহনাজ শারমিন মেয়েটির ছবি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে পাঠান। ওই ছবি দেখে চিকিৎসক সামন্ত লাল আশ্বাস দেন মেয়েটির চিকিৎসা করালে হয়ত সে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারে। এমন আশ্বাস পাওয়ায় ফোরামের জনকল্যাণ সম্পাদক শামসুজ্জামান নাঈম মেয়েটির চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য দায়িত্ব পালনে লেগে পড়েন। তিনি মেয়েটিকে ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে নিয়ে যান। এরপরই অসহায় মেয়েটিকে বিশেষ ব্যবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়। গতকাল রবিবার দুপুরে মেয়েটি’র চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে ফোরামের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে হাসপাতালে চলে যান প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক কাজী ফয়সাল এবং কার্যনির্বাহী সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী হাসিব।
এ বিষয়ে ফোরামের সভাপতি মিজান মালিক বলেন, কেবল অসহায় বেদে কন্যা নূরজাহান নয়, বিপদে পড়া চাঁদপুরের সকল শ্রেণীর মানুষের পাশে আমার সবসময়ই আছি এবং থাকবো। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ চলাকালে যখন দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট চলছিল, ঠিক তখনই আমাদের ফোরাম চাঁদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সহায়তা করেছে। এই ফোরাম কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। চাঁদপুরের দুর্নীতিবাজ, ভূমিদস্যু, জলদস্যু, জুলুমবাজ, অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে আমরা আছি। এর জ্বলন্ত একটি উদাহরণ চাঁদপুরের নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী চক্রের বিরুদ্ধে এই ফোরাম থেকেই সর্বপ্রথম বলিষ্ঠকণ্ঠে আওয়াজ তোলার বিষয়টি। যার সুফল এখন চাঁদপুরবাসী ভোগ করছে। এই ফোরাম সর্বদা বিপদগ্রস্থ ও অসহায় মানুষে পাশে রয়েছে এবং থাকবে।
বেদে কন্যা নূরজহানের চিকিৎসার বিষেয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মেয়েটির চিকিৎসার জন্য অর্থ আর দোয়া এখন কেবল এই দু’টি জিনিসই দরকার। চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে প্রায় দু’মাস লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। সে যেহেতু মেয়ে তার কাছে এটেনডেন্ট হিসেবে একজন মেয়ে দরকার। কিন্তু ওদের কোনো মহিলা নেই। সে ব্যবস্থার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ নানাবিধ কাজে টাকা লাগছে।
মানুষের কত ধরনের শখ থাকে। এখন নূরজাহানের কেবল একটাই শখ, পা ভালো হলে সাঁতরিয়ে ডাকাতিয়া নদী পাড়ি দিতে চায় সে।