এবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আলাদা তথ্য আর বিদেশিদের জাতীয়তার ভিত্তিতে তথ্য আনা হবে
–মো. দিলদার হোসেন, প্রকল্প পরিচালক (উপসচিব), জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১
দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে আদম তথা জনশুমারি ও গৃহগণনা শুরু হচ্ছে আজ বুধবার (১৫ জুন)। জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) ডিজিটাল ম্যাপ ব্যবহার করে কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড পারসোনাল ইন্টারভিউইং (সিএপিআই) পদ্ধতিতে ‘ট্যাবলেট’ ব্যবহার করে আজ থেকে আগামী ২১ জুন পর্যন্ত দেশে ষষ্ঠ জনশুমারি চলবে। এতে প্রতিটি ব্যক্তিকে ৩৬টির ওপরে প্রশ্নের তথ্য দিতে হবে।
দেশ স্বাধীনের পর এখন অবধি পাঁচটি আদমশুমারিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল খাতা-কলমে। এবারই প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনশুমারির তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তাছাড়া এবারই প্রথম বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশিদেরও শুমারির আওতায় আনা হচ্ছে। আবার একইসঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের তথ্যও সংগ্রহ করা হবে।
এ সময়ে বিভাগ, জেলা, উপজেলা হতে শুরু করে মৌজা ও গ্রাম পর্যন্ত দেশের সব খানা, গৃহ ও ব্যক্তির তথ্যসংগ্রহ করা হবে। গণনা করতে ইতোমধ্যে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ট্যাব বিতরণ করা হয়েছে। ৩ লাখ ৭০ হাজার তরুণ-তরুণীকে তথ্যসংগ্রহ করতে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এর আগের গণনাগুলো আদম শুমারি বলে পরিচিত হলেও এবার থেকে জনশুমারি ও গৃহগণনা নামে পরিবর্তন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান আইন অনুযায়ী জনশুমারিটি পরিচালনা করছে। এ লক্ষ্যে গতকাল ১৪ জুন দিনগত রাত ১২টায় বাংলাদেশে অবস্থানরত সব দেশি-বিদেশি নাগরিক এবং ছয় মাসের কম সময়ের জন্য সাময়িকভাবে বিদেশে অবস্থানরত সব বাংলাদেশি নাগরিক অন্তর্ভুক্ত হবেন।
জনশুমারি সম্পর্কে জাতিসংঘের ঘোষণায় বলা হয়েছে, একটি দেশ বা সীমানাবেষ্টিত অঞ্চলের সব ব্যক্তির জনতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্য সংগ্রহ, সংকলন এবং প্রকাশের প্রক্রিয়াই হলো জনশুমারি। শুমারি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আইটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার যেমন- সিএপিআই অ্যাপ, ক্লাউভ সার্ভার, ওরাকল এক্সাডাটা সার্ভার, লোড ব্যালেন্সার, ১০ জিবিপিএস ইন্টারনেট, ফাইবার অপটিক্যালে ক্যাবল প্রস্তুত ও ইনস্টল করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে তথ্যসংগ্রহে মোবাইল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট (এমডিএম) সফটওয়্যার ব্যবহার করে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
তথ্যগুলো সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড বিডিসিসিএল এর টিআইইআর আইভি সিকিউরিটি সমৃদ্ধ ডেটা-সেন্টার ব্যবহৃত হবে। বিডিসিসিএল হয়ে বিবিএস সার্ভারে আসার আগ পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত সব পর্যায়ে এনক্রিপটেড অবস্থায় থাকবে। তাতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তাছাড়া জনশুমারি মনিটরে শুমারি পর্যবেক্ষণ অ্যাপ ব্যবহার হবে। এটির মাধ্যমে প্রতিদিনকার তথ্যসংগ্রহের পরিমাণ যেকোনো পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
জাতিসংঘের গাইডলাইন অনুযায়ী তিনটি পদ্ধতিতে জনশুমারি হয়ে থাকে। ১. ডি-ফ্যাক্টো পদ্ধতি অর্থাৎ খানার সদস্যকে শুমারির রাতে অবস্থানকালীন স্থানে গণনা করা। ২. ডি-জুরি পদ্ধতি অর্থাৎ খানার সদস্যকে নিজ নিজ খানায় গণনা করা এবং ৩. মডিফাইড ডি-ফ্যাক্টো পদ্ধতি তথা ডি-ফ্যাক্টোর আওতার বাইরে যারা শুমারি রাত্রিতে ভ্রমণরত, হাসপাতাল ও হোটেলে থাকবেন বা কর্মরত থাকবেন তাদের নিজ নিজ খানায় অন্তর্ভুক্ত করা। ইতোমধ্যে মূলশুমারির কর্মকাণ্ডের জন্য প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জোনাল অপারেশন সম্পাদন করা হয়েছে। একটি ওয়েবভিত্তিক ইন্টিগ্রেটেড সেন্সাস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইসিএমএস) প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রতি ১০০টি খানা নিয়ে একটি গণনা এলাকা গঠন করা হয়েছে। আর প্রত্যেক গণনাকারী প্রতিদিন ১০০-১২০ জন মানুষের কাছে যাবেন তথ্যের জন্য। শুমারির কার্যক্রম ৪টি পর্যায়ে সম্পন্ন হবে। ১. শুমারির প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড, ২. মূলশুমারি পরিচালনা, ৩. শুমারি পরবর্তী যাচাই জরিপ পরিচালন এবং ৪. আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা।
শুমারির উদ্দেশ্য হচ্ছে- ১. দেশের প্রতিটি খানা ও খানার সদস্যগণকে গণনা করে মোট খানা ও জনসংখ্যার হিসাব নিরুপণ, ২. দেশের সব বসতঘর/ বাসগৃহের সংখ্যা নিরূপণ, ৩. দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে তথ্যসংগ্রহ, ৪. স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের জন্য তথ্য সরবরাহ ও ৫. জাতীয় সম্পদের সুষমবণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তথ্য সরবরাহ করা। ‘জনশুমারিতে তথ্য দিন, পরিকল্পিত উন্নয়নে অংশ নিন’ স্লোগানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া শুমারির প্রচারের জন্য রাষ্ট্রপতির স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দান, রেডিও-টেলিভিশন, প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, ডকোমেন্টারি ও নাটিকা প্রচার ও প্রকাশ করা হবে।
দেশের ৪০টি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় প্রশাসনিক পর্যায়ে ৬টি পর্যবেক্ষণে মনিটরিং করা হচ্ছে। যতদ্রুত সম্ভব ফল প্রকাশ করা হবে। বাদ পড়াদের ক্ষেত্রে ৪০টি টেলিফোনের মাধ্যমে তথ্য দেয়া-নেয়া হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারির ব্যবস্থা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন তিনি বলেন, ‘যথাযথ উন্নয়নের জন্যে নির্ভুল পরিসংখ্যান চাই’। প্রথম আদমশুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ। ১৯৮১ সালের দ্বিতীয় গণনায় ৮ কোটি ৯৯ লাখ, ১৯৯১ সালের তৃতীয় গণনায় ১১ কোটি ১৫ লাখ, ২০০১ সালে চতুর্থ গণনায় ১৩ কোটি ৫ লাখ ও ২০১১ সালের পঞ্চম আদমশুমারিতে ১৪ কোটি ৯৮ লাখ জনসংখা ছিল। পরবর্তী শুমারি ২০২১ সালে হওয়ার কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতি ও ট্যাব সংক্রান্ত বিষয়ে সময় পরিবর্তন করে চলতি বছরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২১ প্রকল্পের পরিচালক (উপসচিব) মো. দিলদার হোসেন জানান, ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে ও বিশ্বে প্রথম ডিজিটাল শুমারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগে আদম শুমারি নাম থাকলেও বর্তমানে এটিকে জনশুমারি হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৫ হতে ২১ জুন পর্যন্ত জনশুমারি ওয়েবভিত্তিক আইসিএমএস প্রস্তুতসহ জিআইএস পদ্ধতি ব্যবহার করে গণনা এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের কন্ট্রোল ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। জনশুমারির তথ্য সংগ্রহের জন্য ৩ লাখ ৭০ হাজার গণনাকারী, ৬৪ হাজার সুপারভাইজার ও ৪ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবে। এ ছাড়াও বিবিএসের বাইরে সরকারি দপ্তরের ৯ শতাধিক কর্মচারী জোনাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, বিবিএসে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্যে ০৯৬০২৯৯৮৮৭৭ এই নাম্বারে অত্যাধুনিক কল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ৪০ জন কর্মী ২৪ ঘণ্টায় শুমারি বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করবে। এবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আলাদা করে তথ্য নেয়া হবে। তা ছাড়া বিদেশিদের জাতীয়তার ভিত্তিতে তথ্যও আনা হবে। প্রতিটি পরিবারে ২০ মিনিটের মতো সময় লাগবে তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে। আর প্রতিজন গণনাকারী ১২০ জনের মতো লোকের তথ্য সংগ্রহ করবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। ভ্রাম্যমাণদের গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আনন্দবাজার/শহক