পাবনার বিভিন্ন উপজেলায় কালের পরিক্রমায় আধুনিকতার স্পর্শে সেই ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি এখন শুধুই অতীতের স্মৃতি। আবহমান গ্রাম বাংলার একসময়ের ঐতিহ্যবাহী বাহন হিসেবে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। গ্রামবাংলায় গরুর গাড়িই ছিল যোগাযোগের একমাত্র বাহন। গ্রামগঞ্জে আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ধীরে ধীরে বয়ে চলা গরুর গাড়ি এখন আর চোখে পড়ে না। গরুর চালককে বলা হতো গাড়িয়াল। তাকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছে বিখ্যাত গান ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’।
তাছাড়াও ‘তোমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ গান শুনলে অগোচরেই চোখে ভাসে মেঠো পথের ধারে ভাওয়াইয়া সুরে গাড়িয়াল ভাইয়ের গরুর গাড়ি। গ্রামগঞ্জে বিবাহের বর কনে আসা-যাওয়া করতো গরুর গাড়িতে। রাত-দুপুরে, ঘন অন্ধকারে বা জ্যোস্নার আলোয় আঁকাবাঁকা মেঠো পথে গাড়িয়াল গরুর গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিত। বরযাত্রী থেকে শুরু করে কনে আনা চলত এ গাড়ি দিয়ে।
একসময় গরুর গাড়ি মেঠো পথের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হলেও যুগের পরিবর্তনে কদর বাড়েছে দ্রুতগতির মোটরচালিত যানবাহনের। কাঠের তৈরি দুই চাকা বিশিষ্ট গরু গাড়ির সামনে থাকে একটি জোয়াল, যা গরুর কাঁধে রাখা হয়। দুটি গরু মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। চালক গাড়ির সামনে বসে। গরুর গাড়ির ইতিহাস সুপ্রাচীন। নব্যপ্রস্তর যুগের সময় থেকেই মানুষ এই বাহনটি ব্যবহার করে আসছিল। এগুলো থেকে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ১৫ থেকে ১৬ শত বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। যা সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে ছড়িযে পড়েছে গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে।
তার পেছনে বসত যাত্রীরা। সবার পেছনে রাখা হতো মালপত্র। গরুর গাড়িতে যাত্রীদের বসার জন্য পাটাতন রাখা হয়। পাটাতন বানানো হতো বাঁশ বা কাঠ দিয়ে। এ ছাড়া যাত্রীদের রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে গাড়ির ওপরে বসানো হতো ‘ছই’। দুই তিন যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলে গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়ে কল্পনা করা যেত না। বরপক্ষের লোকজন ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ি সাজিয়ে রওনা হতো কন্যার বাবার বাড়ির পথে। তা ছাড়াও এক সময় ধান চাল সহ অন্যান্য মালামাল পরিবহণের জন্য যেসব পরিবারে গরুর গাড়ি ছিল, তাদের কদর ছিল বেশি।
আটঘরিয়া উপজেলার সিংহরিয়া গ্রামের সরদার আরিফ জানান, আমাদের একটা গরুর গাড়ি ছিল। ধান, পাট, গম, কুটা, কুড়া, খৈলসহ অন্যান্য মালামাল আনা নেওয়ার জন্য। তবে আজ প্রায় ৫ বছর গরুর গাড়ি বন্ধ থাকায় চাকা জোয়াল পাটাতন ঘুনে ধরে নষ্ট হয়ে গেছে যা বাড়ির রান্নার খড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
শুধু তাই নয় জমি থেকে ধান আনা, মালামাল পরিবহণ ও যানবাহন হিসেবে গরুর গাড়ি ছিল অপরিহার্য। এখন গরু-মহিষের গাড়ি প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। আজকাল শহরের সঙ্গে গ্রামেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিক যানবাহনের ভিড়ে ঐতিহ্যবাহী যানবাহনটি আজ বিলুপ্তির পথে।