ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতেও কর্মসংস্থান হ্রাস

দেশে ২০১০ সালের পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমেছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির অভিঘাতে বেকারত্ব হার বেড়েছে আগের দশকের তুলনায়। এ অবস্থায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে অভিমত জানিয়েছেন বক্তারা। আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মূল্য সংযোজন কর আমি বুঝি না। এটি সহজ করতে হবে। কেননা অর্থনীতি আমাদের পরিবর্তন করে না আমরা অর্থনীতিকে পরিবর্তন করি এটি মাঝে মধ্যে চিন্তায় ফেলে দেয়। অর্থনীতিবিদরা এ বিষয়ে চিন্তা করবেন।

বাড়ছে ক্ষুদ্র-প্রান্তিক চাষির সংখ্যা

দারিদ্র্যের হার–
১৯৭২ সালে ৮২ শতাংশ
২০১৬ সালে নেমে ১৪.৫

দেশে ২০১০ সালের পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমেছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির অভিঘাতে বেকারত্ব হার বেড়েছে আগের দশকের তুলনায়। এ অবস্থায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে অভিমত জানিয়েছেন বক্তারা। আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মূল্য সংযোজন কর আমি বুঝি না। এটি সহজ করতে হবে। কেননা অর্থনীতি আমাদের পরিবর্তন করে না আমরা অর্থনীতিকে পরিবর্তন করি এটি মাঝে মধ্যে চিন্তায় ফেলে দেয়। অর্থনীতিবিদরা এ বিষয়ে চিন্তা করবেন।

গতকাল সোমবার বিকালে রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-বিআইডিএস মিলনায়তনে রুশিদান ইসলাম রহমান, রিজওয়ানুল ইসলাম ও কাজী সাহাবউদ্দিন প্রণিত ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা: সুবর্ণজয়ন্তীতে ফিরে দেখা’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন।

বিআইডিএসের মহাপরিচাল ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি, বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও ড. মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

ড. মশিউর রহমান বলেন, নারীরা অনেক সময় পৈত্রিক সম্পত্তি থাকলেও নানান কারণে তা পায় না। এমনকি নারীরা কত শ্রমঘণ্টা দেয় সে হিসেবও নেই। তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে এটি প্রয়োজন। ফিনল্যান্ডে বেশি ও আমেরিকায় নারীরা পরিবারে সময় বা শ্রমঘণ্টা কম দেয়। তিনি বলেন, কৃষিশ্রমে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কেননা আমাদের মৌসুমী শ্রমিকের অভাব আছে। এজন্য সরকার কিছু সুবিধা দিচ্ছে।

বইটিতে বলা হয়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পেছনের দিকে ফিরে তাকালে দেশের অর্থনৈতিক অর্জন সম্পর্কে গর্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ পাওয়া যায়। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, ‘উন্নয়নের পরীক্ষা’ এ ধরনের বর্ণনা থেকে দেশটি এখন নিম্নমধ্যম আয়ের কাতারে উঠেছে এবং স্বল্পোন্নত আয়ের দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ১৯৭২ সালে যে দেশের মাথাপিছু আয় (জিএনআই) ছিল ১০০ মার্কিন ডলার, তার আয় ২০২০ সালে ২০৩০ ডলার। এই অর্জন দাঁড়িয়েছে তিনটি প্রধান স্তম্ভের ওপর- ১. কৃষিতে উচ্চ ফলনশীল ধান ২. শ্রমনিবিড় রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প এবং ৩. বিদেশে কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স। তিনটিতেই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে শ্রম এবং শ্রমজীবী মানুষ। যদিও প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তার কথাও বলতে হবে।
কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে বলা হয়, ১৯৮০-৮১ সাল থেকে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত ধান উৎপাদন বেড়েছে আড়াই গুণ। মোট ধানের জমিতে উফশীর অংশ এক পঞ্চমাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ। এই ধানের জন্য শ্রমের প্রয়োজন হয় বেশি। তৈরি পোশাকখাতে সৃষ্টি হয়েছে প্রায় চার লাখ মানুষের কর্মসংস্থান আর সেটি হচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রাঅর্জনের প্রধান মাধ্যম। তেমনি ভূমিকা বৈদেশিক কর্মসংস্থানের।

লেখকরা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের অর্জন নিঃসন্দেহে উল্লেখ করার মতো। তবে উন্নয়নে সফল দেশগুলো বিশেষ করে চীন এবং ভিয়েতনামের দিকে তাকালে একটু সংযত বা বিনয়ী হতে হয়। আর অর্জনের পাশাপাশি রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। পরবর্তী দুটি মাইলফলক- ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে উঠতে হলে প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮.৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ। আর বিনিয়োগ হতে হবে জিডিপির ৪১ শতাংশ থেকে ৪৭ শতাংশ যা এখন ৩২ শতাংশ। এসব অভীষ্ট কতটা বাস্তবসম্মত সেটি ছিল আলোচনার বিষয়। তার ওপর এসে গেল কোভিড মহামারি; এবং সে সংকট থেকে পুরোপুরি উত্তরণের আগেই আবার ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক মন্দার ভয়।

পোশাকশিল্প ও রেমিট্যান্স সম্পর্কে বলা হয়েছে, আগের ঝুঁকি ছিল একটিমাত্র শিল্প এবং রেমিট্যান্সের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা। শিল্পখাতে তৈরি পোশাকের পর সে রকম উল্লেখযোগ্য কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। অন্য যেসব শিল্পের কথা সচরাচর বলা হয়, মোট উৎপাদন বা মূল্য সংযোজনে তাদের অংশ অতি সামান্য। এখন চ্যালেঞ্জ একদিকে প্রাক-মহামারি সময়ের প্রবৃদ্ধির হারে ফিরে যাওয়া এবং সেখান থেকে ৮.৫ শতাংশ -৯ শতাংশ তোলা, আর অন্যদিকে নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা এবং সবার জন্য টেকসই সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।

কৃষি সম্পর্কে বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে কাঠামোগত রূপান্তরের ফলে মোট জিডিপিতে কৃষির অংশ কমলেও মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ এখনো এর ওপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক সময়ে এই খাত বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। একদিকে বাড়ছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির সংখ্যা এবং অন্যদিকে কৃষি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে বর্গাচাষে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দ্রুত নগরায়নে কৃষিখাতের বাইরে খাদ্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছে উচ্চ হারে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবিলা করতে হলে বাড়াতে হবে বাজারজাত উদ্বৃত্ত শস্যের পরিমাণ। এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

খাদ্য বিতরণব্যবস্থা শক্তিশালী সম্পর্কে বইটিতে বলা হয়েছে, খাদ্যশস্যে বিশেষ করে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরকারি খাদ্য বিতরণব্যবস্থা শক্তিশালী করার মাধ্যমে বাংলাদেশ খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। অন্যদিকে অন্যান্য ফসলের বিশেষ করে ডাল এবং তৈলবীজের উৎপাদন হ্রাস এবং তাদের সরবরাহের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তা ছাড়া রয়েছে মৌসুমী এবং সাময়িক খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা। সুতরাং খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য ধরে রাখতে হলে বহুমুখী প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

কর্মসংস্থান বিষয়ে বলা হয়েছে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সাফল্যের মাধ্যমে কীভাবে প্রবৃদ্ধি দ্রুততর হতে পারে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন দ্রুত বাড়ে, দারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্য আসে তার উদাহরণ স্থাপিত হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। কর্মসংস্থানের কাঠামোতে পরিবর্তন হয়েছে। শিল্প ও সেবাখাতে যেখানে উৎপাদনশীলতা বেশি সেখানে শ্রমশক্তির অনুপাত বেড়েছে। ১৯৭০ এর দশকে কৃষিতে ছিল ৮০ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান, বর্তমানে ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তৈরি পোশাকখাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং বড় সংখ্যায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি বৃদ্ধি প্রবৃদ্ধির ভিতকে সবল করেছে। পরিবারে উপার্জনকারীর অনুপাত বাড়িয়ে দারিদ্র্য হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছেন অনেকে। প্রয়োজনে অনানুষ্ঠানিক নিয়োজন, স্বনিয়োজনের পথে অগ্রসর হয়েছেন।

শ্রমশক্তিতে শিক্ষিতদের অনুপাত বেড়েছে। এ সম্পর্কে আরো বলা হয়, শ্রমশক্তিতে শিক্ষিতদের অনুপাত বৃদ্ধির ফলে উৎপাদনশীলতা ও মজুরি বেড়েছে। নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নারী-পুরুষ মজুরি বৈষম্য হ্রাস ও নারীর শিক্ষাতে অগ্রগতির ফল হিসেবে ক্ষমতায়নের পথেও কিছুটা সাফল্য এসেছে যদিও আরো অনেক পথ বাকি। এই পাঁচ দশকে আংশিক বেকারত্বের হার কমেছে বড় মাপে। তবে ২০১০-এর পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমেছে। ২০২০ এবং ২০২১ সালে কোভিড মহামারির অভিঘাতে বেকারত্ব হার বেড়েছে আগের দশকের তুলনায়।

দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের সাফল্য স্বীকৃত ও সুবিদিত। সম্পর্কে বইটিতে বলা হয়, শুধু জাতীয় দারিদ্র রেখার ভিত্তিতে নয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিম্নতর রেখা অনুযায়ী ১৯৭২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে নেমে এসেছে ১৪.৫ শতাংশে। তবে গত কয়েক দশকে আয়ের বণ্টনে অসাম্য বেড়েছে অনেক। তা ছাড়া দারিদ্র্য হ্রাসের এই ধারা কতটা টেকসই সে প্রশ্ন বিশেষভাবে উঠছে কোভিড মহামারির অভিঘাতে দারিদ্র্য বৃদ্ধির ফলে। আরেকটি প্রশ্ন সম্মুখে এসেছে, কারণ বহুমাত্রিক মানদণ্ড (যেখানে জীবনমানের অন্যান্য দিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুপেয় জল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত) অনুযায়ী এদেশের সাফল্য তুলনামূলকভাবে কম, এই মানদণ্ডে ২০০৪ ও ২০১৪ সালে দারিদ্র হার ছিল ৬৬ ও ৪২ শতাংশ। তার অর্থ এই যে দেশ যখন ন্যূনতম ব্যয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রসর হচ্ছে, জীবনমানের অন্যান্য দিকে মনোযোগ দেওয়াও তখন জরুরি।

বৈষম্য বৃদ্ধির প্রবণতা রোধ এবং দারিদ্র্যের হার কমানো ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য একটি সামগ্রিক নীতিকাঠামো জরুরি হয়ে পড়েছে বলে লেখকরা মনে করেন। তারা বলেন, শ্রমঘনখাত উৎসাহিত হয় এবং তার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ঘটে সে পথের দিশা থাকবে। শ্রমশক্তির শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চাহিদার উপযোগী যোগ্যতা বৃদ্ধির উপর জোর থাকবে আর থাকবে কর্মসৃজনের জন্য প্রত্যক্ষ কার্যক্রম ও প্রণোদনা এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সঠিক সুসমন্বিত কর্মপরিকল্পনা।

সংবাদটি শেয়ার করুন