ঢাকা | বুধবার
১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাবার খোঁজে অবুঝ শিশু ফাইজা-মারিয়া

বাবার খোঁজে অবুঝ শিশু ফাইজা-মারিয়া

ডিএনএ নমুনা দিচ্ছে স্বজনরা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক আবদুস সোবহান; তার লাশ খুঁজে পেতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছে ৭ মাস বয়সী মেয়ে ফাইজা।

এখনো পৃথিবী কি তাও এখনও বোধগম্য হয়নি তার। শুধু বাৃবাবাৃবা..বা.. ডাকতে শিখেছে। এই যে তার মুখে বা..বা ধ্বনি, সেটাও বুঝতে শেখেনি এই অবুঝ শিশু। সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে পর থেকে আবদুস সোবহান রহমানের খোঁজ নেই। এই আবদুস রহমান ফাইজার বাবা। সব হাসপাতাল খুঁজেও স্বজনরা আবদুস সোবহানকে সন্ধান করতে পারেননি। পরে মা ইস্পাহান সুলতানার কোলে করে ডিএনএ দিতে এসেছে ফাইজা রহমান।

আবদুস সোবহান রহমান চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শেখেরখীল এলাকার বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আইসিটি সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সামনে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রে ফাইজা রহমানের নাক থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভাইয়ের লাশ শনাক্তে বোন উম্মে কুলসুমও ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন।

মেয়েকে কোলে নিয়ে ইশপাহান সুলতানা বলেন, ‘শনিবার রাত ১১টার দিকে সোবহানের সঙ্গে কথা হয়েছে। ভিডিও কল করে আগুন দেখিয়েছে। সেখান থেকে তাকে বারবার বলেছে বের হয়ে যেতে সে বলেছে কোনো কিছু হবে না। প্রথমে আমাকে আগুন দেখিয়ছি, এরপর আমার শাশুড়িকে। পরে বোনকে আগুন দেখানোর সময় বিকট শব্দের একটি আওয়াজ শুনতে পাই। এরপর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, রবিবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতাল খুঁজেছি, কোথাও পাইনি। তাই একমাত্র মেয়ে ডিএনএ দিতে হাসপাতালে এসেছি। মেয়ের ডিএনএ দিয়েছি। সরকারের কাছে কোনো চাওয়া নেই। সোবহানকে যেন একনজর শেষ দেখা দেখতে পারি।’

এদিকে, বিস্ফোরণের পর থেকে খোঁজ মিলছে না মো. রুবেলের (২৬)। তিনি সেখানে কাজ করতেন। বিস্ফোরণে মারা গেছেন নাকি বেঁচে আছেন কেউ বলতে পারছে না। সোমবার (৬ জুন) সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ডিএনএ নমুনা দিতে আসেন রুবেলের স্ত্রী মুন্নি আকতার। এ সময় তার কোলে ছিল তিন বছরের সন্তান মারিয়া আকতার।

মুন্নি আকতার বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। ৩ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে আমার স্বামীর খোঁজ পাচ্ছি না। সব হাসপাতালে গিয়েছি, কেউ তার সন্ধান দিতে পারেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে এসে শুনি, যেসব লাশের পরিচয় মেলেনি, বা যারা স্বজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না, তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাই আমি ও আমার মেয়ে নমুনা দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছি।’

অপরদিকে, হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটেও ভাই মনির হোসেনের (৩২) খোঁজ পাননি ছোট বোন মোহছেনা আকতার কলি। মনির সীতাকুণ্ড উপজেলার ফকিরহাট এলাকার আবদুল হান্নানের ছেলে। কলি বলেন, ‘ছয় মাস আগে আমার ভাই বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রী রহিমা আকতার পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে তার খোঁজ মিলছে না। আমরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছি।’

বাবা আবদুল হান্নান বলেন, ‘১০ বছর ধরে আমার ছেলে এই ডিপোতে কাজ করছে। সে গাড়িচালক ছিল। দুর্ঘটনার পর থেকে তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাই ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছি।’ বিস্ফোরণের পর থেকে সন্ধান মিলছে না বিএম কনটেইনার ডিপোর গাড়িচালক আবুল হাসেমের (৪৫)। তিনি সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা এলাকার ছগির আহমেদের ছেলে। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। আবুল হাসেমের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছেন ভাই আনিসুল হক। সকালে চমেক হাসপাতালে ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছেন। আনিসুল হক বলেন, ‘আবুল হাসেম বিএম কনটেইনার ডিপোর গাড়িচালক। ঘটনার পর থেকে তার খোঁজ পাচ্ছি না। আমরা সব হাসপাতাল ঘুরেও খুঁজে পাইনি।’

বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে আরও অনেকের মতো খোঁজ মিলছে না মাঈন উদ্দিনের। তার সন্ধানে  চমেক হাসপাতালে ভিড় করেছেন স্বজনরা। ছেলের সন্ধানে ডিএনএ নমুনা দিতে নোয়াখালীর দক্ষিণ হাতিয়া থেকে এসেছেন হেমায়েত উল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘দুই বছর ধরে বিএম কনটেইনার ডিপোতে গাড়ি চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করছে আমার ছেলে। বিস্ফোরণের সময় সে ঘটনাস্থলে ছিল। এরপর থেকে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’

হেমায়েত উল্লাহ আরও বলেন, ‘ঘটনার সময় আমাকে ফোন করেছিল। ভিডিও কলে আগুন দেখিয়েছিল। আমরা তাকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু তার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে গিয়েও খুঁজে পাইনি।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমারজেন্সি কেয়ারের সামনে নমুনা সংগ্রহ করছে সিআইডি। সিআইডির ফরেনসিক সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘যাদের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি, তাদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।’ বাবা-মা ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ের যেকোনো দুই জনের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। মরদেহের সঙ্গে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পরিচয় শনাক্ত করা হবে। ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে এক মাসের মতো সময় লাগতে পারে। এদিকে, শনাক্ত হওয়া ২৩ জনের মধ্যে ২২ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন