ঢাকা | বুধবার
১৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৩১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিষাক্ত ধোঁয়ায় কবলে সীতাকুণ্ড

বিষাক্ত ধোঁয়ায় কবলে সীতাকুণ্ড

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে আশপাশের চার উপজেলার বিস্তৃত এলাকা। ভয়াবহ সেই বিস্ফোরণে চোখের সামনে উড়ে গেছে কনটেইনার, মানুষ। প্রাণ হারিয়েছে অর্ধশতাধিক। আহত হয়েছেন পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসকর্মসহ তিন শতাধিক মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত হতে না পারলেও বিস্ফোরণের আগে ও পরের অগ্নিকাণ্ডে পণ্যভর্তি বহু কনটেইনার উড়ে ও পুড়ে গেছে।

এদিকে, কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ফলে আগুন, উত্তাপ ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে অন্তত আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকায়। আগুন আর ধোঁয়ার প্রভাব ছড়িয়েছে অন্তত ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্থ জুমের স্যাটেলাইট ইমেজ বা ছবি বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন স্কটল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন্দন মুখার্জি।

বিষাক্ত ধোঁয়ায় কবলে সীতাকুণ্ড

গত শনিবার রাত ১১টায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় আশপাশের চার বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিপোটিতে ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। যা উত্তপ্ত হওয়ায় তাপীয় বিয়োজনে বিস্ফোরকে পরিণত হয়েছে। রাসায়নিক বিস্ফোরণে গোটা সীতাকুণ্ডের আকাশ বাতাস বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে।

ঘটনাস্থলের আশপাশের গ্রামগুলোতে ছাই আর পোড়া গন্ধে বিপাকে পড়েছে মানুষ। বিশেষ করে শিশু আর বৃদ্ধরা বিষাক্ত ধোঁয়া আর কেমিকেলের পোড়া গন্ধের কারণে অস্বস্তি বোধ করছে। অনেকে নাখ-মুখ ঢেকে বা মাস্ক পরে চলাচল করছেন। এমনকি ঘটনাস্থলের উদ্ধারকর্মীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন্দন মুখার্জি একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, সীতাকুণ্ডের ডিপো এলাকার ওপর দিয়ে বাতাস ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার বেগে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যাওয়ার ফলে আগুন, কালো ধোঁয়া ও উত্তাপের প্রভাব কুমিরা, বাড়বকুণ্ড ও সীতাকুণ্ড শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, আগুনের প্রভাব যেদিকে বিস্তৃত হচ্ছে, প্রতিবেশগতভাবে বিপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত সেই এলাকায় রয়েছে সংরক্ষিত এক বনভূমি।

যেভাবে ঘটনার শুরু
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রমতে, সীতাকুণ্ডের কাশেম জুট মিলস সংলগ্ন বিএম কন্টেনার ডিপো চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ স্মার্ট গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। সাত হাজার টিইইউএস ধারণক্ষমতার এই কন্টেনার ডিপোতে সাড়ে ৪ হাজারের মতো কনটেইনার ছিল। এর মধ্যে ১৬টি কনটেইনার ছিল হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের। নিজেদের অপর একটি কারখানায় উৎপাদিত অত্যন্ত দাহ্য এই কেমিক্যাল ভর্তি কনটেনারগুলো ডিপোর এক পাশে ছিল। এইগুলোর একটিতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় শনিবার দিনগত রাত ৯টায়।

তবে কোথা থেকে কীভাবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত তা জানা না গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এত বেশি দাহ্য পদার্থ যে, সামান্য উৎস থেকেই এগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। ডিপোতে রক্ষিত ১৬টি কনটেনারের একটিতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়। খবর জানানো হয় শিল্প পুলিশকে। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিভানোর জন্য কাজ শুরু করে। পুলিশও অবস্থান নেয় ঘটনাস্থলে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে সীতাকুণ্ডের বিস্তৃত এলাকার পাশাপাশি হাটহাজারী, রাউজান ও মীরসরাইয়ের অনেক এলাকা কেঁপে ওঠে। অনেক উপরে উঠে যায় কনটেইনারসহ নানা পণ্য। আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিশাল কনটেইনার ডিপোর পাশাপাশি কাছের দুটি বাড়িতেও আগুনের বিস্তার ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

কাশেম জুটসহ কাছের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ এত তীব্র হয় যে তাতে বাড়িঘর এবং মসজিদের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। ঘটনায় পুরো এলাকায় তীব্র আতংক দেখা দেয়। অনেকেই বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকেন। পুলিশ জানিয়েছে, থানা পুলিশের কনস্টেবল তুহিনের পা বিচ্ছিন্নসহ আরও অন্তত ৫ কনস্টেবল, ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মোতাহার হোসেন ও শিল্প পুলিশের একাধিক সদস্য আহত হয়েছেন।

ঘটনার পর ডিপোর ভিতরে রক্তাক্ত মানুষের আহাজারি শুরু হয়। ফায়ার সার্ভিসের ১০ জনের মতো কর্মী আহত হন। এক পুলিশ সদস্যের পা উড়ে যায়। গুরুতর আহত হন ৫ জন কনস্টেবলসহ ৯ পুলিশ সদস্য। ডিপোর অনেক শ্রমিক-কর্মচারী এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকেই আহত হন। আগুনের লেলিহান শিখা এত ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষেও কাজ করা কঠিন হয়ে উঠছিল। সাধারণ মানুষ দূর থেকে আহাজারি করলেও আগুন নিভানো কিংবা হতাহতদের উদ্ধারে কাছে যেতে পারছিলেন না।

এদিকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন বিএম ডিপো থেকে দলে দলে আহতদের এনে রাস্তায় বিভিন্ন গাড়িতে তুলে দেয়া হচ্ছিল। অনেক অ্যাম্বুলেন্স রোগীদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। সরকারি-বেসরকারি সব অ্যাম্বুলেন্স ও চট্টগ্রাম শহর থেকে অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে অগ্নিদগ্ধদের হাসপাতালে নিয়ে আসে। ভাটিয়ারীতে শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের হাসপাতাল এবং ভাটিয়ারী মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালেও বেশ কিছু অগ্নিদগ্ধকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

মহাসড়কের কাশেম জুট মিলস এলাকায় ছোপ ছোপ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় রাজপথ। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকেরা বিভিন্ন যানবাহনের গতিরোধ করে আহতদের হাসপাতালে পাঠান। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিন শতাধিক অগ্নিদগ্ধকে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী একজন পুলিশ সদস্য জানান, চোখের সামনে কনটেনার এবং মানুষকে উড়ে যেতে দেখেছি। আমার মনে হয় ১৫/১৬ জন মানুষ কয়লা হয়ে উড়ে গেছে। তবে ঠিক কতজন মারা গেছে সেটি নিশ্চিত হতে সময় লাগবে।

বিষয়টি নিয়ে বিএম কন্টেনার ডিপোর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে রাতেই যোগাযোগ করা হয়। তারা সবাই নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকে আগুনের সূত্রপাত। তারা বলেন, প্রচুর কনটেইনার রয়েছে ডিপোতে। এর মধ্যে কোথায় আগুন লেগেছে, কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা বলা মুশকিল।

ডিপোর ভিতরে প্রচুর লোক কাজ করে উল্লেখ করে কর্মকর্তারা বলেন, ডিপোর বিশাল কর্মীবাহিনীর পাশাপাশি শত শত ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের চালক-সহকারীও ভেতরে থাকেন। ডিপোতে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হলে এদের অনেকেই আগুন দেখতে বা নিভাতে ওখানে ভিড় করেন। বিস্ফোরণের পর এদের অনেকেই হতাহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শেষ খবরে জানা গেছে, চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ফায়ার সার্ভিস অগ্নিকাণ্ডের কারণ কেমিক্যাল কনটেইনার বলে উল্লেখ করলেও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে কিছু জানাতে পারেনি। আগ্রাবাদ, কুমিরা, বায়েজিদ, সীতাকুন্ড, মীরসরাই ও বন্দরসহ বিভিন্ন স্টেশন থেকে ২৫ ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। এছাড়া আগ্রাবাদ, ফেনী ও হাটহাজারী স্টেশন থেকে চারটি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছে হতাহতদের উদ্ধার করে।

এদিকে রাতেই সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার প্রমুখ চমেক হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান।

সেনাবাহিনীর ২০০ বিশেষজ্ঞ টিমসহ ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিল। পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছে দিনরাত। এদিকে চমেক বার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সংকটাপন্ন তিনজনকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। গুরুতর আহত পুলিশের ৬ সদস্যকে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

চমেক হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে ৫২ জন এবং অর্থোপেডিক বিভাগে ১০ ভর্তি রয়েছে। চমেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ৫২ জন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে। তাদের বেশিরভাগেরই শ্বাসনালী পোড়া। তাদের বাঁচাতে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন