- ইতিহাস-ঐতিহ্য
দক্ষিণাঞ্চলের প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যের একমাত্র নিদর্শন সাড়ে পাঁচশো বছরের পুরানো মজিদবাড়িয়া শাহী মসজিদ। পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলা সদরের ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সাড়ে পাঁচশো বছরের ইতিহাস কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক এই মসজিদটি।
জানা যায়, বৃটিশ আমলের শেষ দিকে সুন্দরবন এলাকার জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় এই মসজিদটির সন্ধান পাওয়া যায়। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয়দের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে,মসজিদটি মাটির নিচ থেকে অলৌকিকভাবে পাওয়া গেছে। ১৯৬০ সালে মসজিদটি মানুষের নজরে আসে। মসজিদটির নামানুসারেই স্থানীয় গ্রাম ও ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়।
দীর্ঘ সংস্কারের অভাবে এখন ধ্বংসের দারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে এই মসজিদ। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এটি এখন হারাতে বসেছে তার ঐতিহাসিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য।
এ মসজিদটি দক্ষিনাঞ্চলে মুসলিম স্থাপত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মসজিদটি এখনো সংরক্ষণ করা না হলে কালে কালে হারিয়ে যাবে সাড়ে পাঁচশো বছরের ইতিহাস বিজড়িত এই মসজিদটি। তাই এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য বাঁচিয়ে রাখতে দ্রুত সংস্কারের দাবী স্থানীয়দের।
মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে থাকলেও সংস্কারের অভাবে এর সৌর্ন্দয্য নষ্ট হয়ে বর্তমানে ধ্বংসাবশেষে পরিনত হয়েছে। এই ঐতিহাসিক নিদর্শন আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সরকার দৃষ্টি রাখবে এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।
দৈনিক আনন্দবাজারকে স্থানীয়রা বলেন, প্রতিদিন এলাকার বহু মানুষ এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসে। মসজিদটির চারদিক ভাঙা, যেকোন সময় ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভেঙে পরার পূর্বেই সংস্কারের মাধ্যমে ঐতিহাসিক এই মসজিদটি সংরক্ষন করা জরুরী।প্রায়ই দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ প্রাচীন এই মসজিদ পরিদর্শনে আসেন। তাদের জন্যে একটি বিশ্রামাগার প্রয়োজন।এছাড়া মসজিদের পাশে যে দিঘীটি রয়েছে সেখানে কোন ঘাট না থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাদের। এরকম আরও নানান সমস্যা রয়েছে। এর জন্যে আমরা সরকারের কাছে দাবী জানাই, দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা তৈরী করে আমাদের এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক এ মসজিদটি সংরক্ষণ করার। নয়তো দিনে দিনে মাটির সাথে একদিন মিশে যাবে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা।
মসজিদের গায়ে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীন বাংলার ইলিয়াস শাহীর শাসনামলের শেষের দিকে সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের পুত্র রুকনউদ্দিন বারবক শাহের (১৪৫৯-১৪৭৬খ্রীঃ) শাসনামলে খান-ই মোয়াজ্জম উজিয়াল খান ১৪৬৫ খ্রীষ্টাব্দে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে উল্লেখিত শিলালিপিটি কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।
সারেজমিনে দেখা যায়, মসজিদটির দৈর্ঘ্যে ৪৯ ফুট এবং প্রস্থ ৩৫ ফুট। এছাড়া পূর্ব দিকে রয়েছে সাড়ে ২১ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৮ ফুট প্রস্থ একটি বারান্দা। দেখা যায়,মসজিদটির প্রধান কামরা বর্গাকারে নির্মিত এবং প্রত্যেকটি বাহু সাড়ে ২১ ফুট লম্বা। মসজিদের দেয়াল গুলি প্রায় সাড়ে ৬ ফুট চওড়া। মসজিদের পূর্ব দিকে ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৪টি করে দরজা।
পশ্চিম দিকের দেয়ালে ৩টি মেহরাব আছে। প্রধান কামরার উপরে আছে আধা গোলাকৃতির একটি সুন্দর বিরাট গম্বুজ। বারান্দার ছাদ চৌচালা ঘরের আকারে নির্মিত। মসজিদটির প্রধান কামরার ৪ কোনায় ৪টি এবং বারান্দার ২ কোনায় ২টি মিনার আছে। মসজিদে পাশেই রয়েছে এক বিশাল দীঘি।
জানা যায়, মসজিদ সংলগ্ন চত্বরে প্রতি বছর ওয়াজ মাহফিল হয়। আর এ ওয়াজ মাহফিলে দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উপস্থিতিতে জমজমাট থাকে মসজিদ প্রাঙ্গন। মসজিদের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন পরগনার ইয়াকনি শাহ ও কালাশাহ। মসজিদের দক্ষিন র্পূব পাশে রয়েছে আরো দুটি কবর।
মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোসাঃ তানিয়া ফরেদৌস দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সংস্কার করার৷ যেহেতু এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় রয়েছে তাই আমরা মসজিদটির ঐতিহ্য রক্ষা ও মেরামতের মধ্যে দিয়ে সংরক্ষণ করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে কথা বলবো।
মির্জাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খান মোঃ আবু বকর সিদ্দিকী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের জন্য আমরাদের উপজেলা পরিষদের এডিপির বরাদ্দ থেকে আমরা কোন অর্থ দিতে পারিনা। আমরা ইতিমধ্যে টিআর এর মাধ্যমে কিছু সংস্কার করেছি। আমরা আমাদের দিক থেকে উচ্চপর্যায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি সংরক্ষণ করা হয়।
মসজিদটি দ্রুত সংস্কাররে মাধ্যমে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের ইতিহাস, মুসলমানদরে অবদান ও ঐতিহাসিক নিদর্শন আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সরকার দৃষ্টি দেবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।