বেশ কয়েক বছর ধরে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে বিশাল বিশাল মাটির চুল্লি বানিয়ে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করছে একটি অসাধু চক্র। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় আশপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন ধরণের বনজ ও ফলজ গাছ কেটে এসব অবৈধ চুল্লিতে দেদারছে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ এবং তা থেকে তৈরি হচ্ছে কয়লা। এসব চুল্লি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। চরম হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নানা ফল ও ফসল, কমে যাচ্ছে জমির উর্বরতা। স্থানীয় প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিভিন্ন সময় এদের জরিমানা ও উচ্ছেদ করলেও কিছু দিনের মাঝেই অন্য এলাকায় গিয়ে তারা পুণরায় একই কাজ শুরু করে।
জেলার কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের গিয়াসপুর ও নরোত্তমপুর এবং কাপাসিয়া সদর ইউনিয়নের সূর্য নারায়ণপুর এলাকায় বর্তমান সময়ে অবাধে চলছে কাঁচা কাঠ পুঁড়িয়ে কয়লা তৈরির মহা কর্মযজ্ঞ। সরেজমিনে দেখা যায়, বারিষাব ইউনিয়নের নরোত্তমপুর গ্রামের জহিরুলের প্রায় একবিঘা জমির প্রত্যন্ত জঙ্গলে ৮টি চুল্লি বানিয়ে দিনরাত কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। তার কাছ থেকে মাসিক চুক্তিতে জমি ভাড়া নিয়েছেন শ্রীপুর উপজেলার বরমী এলাকার ব্যবসায়ী আবুল হোসেন (৪৫) এবং শফিকুল ইসলাম (৩৫)। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক যুবক জানান, তাদের এলাকায় আগেও এধরণের চুল্লি বসিয়ে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করতেন ব্যবসায়ীরা। পরে প্রশাসনের অভিযানে তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুদিন পর আবারও চুল্লি বসিয়ে কাঠ পুড়াচ্ছেন কয়লা ব্যবসায়ীরা। তাদের সাথে যুক্ত স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না।
একই ইউনিয়নের গিয়াসপুর ভেড়ারচালা এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ৭টি চুল্লিতে একইভাবে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানানো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, প্রতিদিন শত শত মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে এই চুল্লিগুলোতে। এতে উৎপাদিত ধোঁয়ার গন্ধে নাক-মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ইদানিংশ্বাস প্রশ্বাসেও ব্যাঘাত ঘটছে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
তিনি আরো বলেন, দিনের বেলা যাই হোক না কেন মধ্যরাতে ঘর থেকে বের হয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে শ^াস নেওয়া যায় না। শুধুমাত্র কাঠ পোড়ানোর কালো ধোঁয়ার কারণে এই পর্যন্ত কয়েকজনের বেশ কয়েকটি গরু মারা গেছে।
এসব চুল্লিতে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাটি, ইট ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল বড় আকারের এসব চুল্লি। চুল্লির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে কাঠ সাজিয়ে একটি মুখ খোলা রেখে অন্য মুখগুলো মাটি এবং ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোলা মুখ দিয়ে আগুন দেওয়া হয় চুল্লিতে। আগুন দেওয়া শেষে সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় ১০ দিন পোড়ানোর পর চুলা থেকে কয়লা বের করা হয়। প্রতিটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ৩০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। পরে সেই কয়লা ঠান্ডা করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে গিয়াসপুর এলাকায় অবৈধ মাটির চুল্লি বসিয়ে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করে আসা শ্রীপুর উপজেলার বরমী এলাকার কয়লা ব্যবসায়ী মোঃ জাকির হোসেন মুঠোফোনে জানান, এইসব কয়লা তৈরির চুলার জন্য কিসের অনুমতি নিতে হয় তা আমার জানা নেই। আমার জানামতে পরিবেশের কোন ক্ষতিসাধন হচ্ছেনা এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিও না। আর আমি স্থানীয়দের এবং সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই ব্যবসা করি।
এ সব চুল্লির মালিকদের সাথে সংশ্লিষ্টার দায়ে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য কামাল হোসেন মুঠোফোনে জানান, এসব চুল্লিতে কাঠ পোড়ানোর ফলে কোন ধরণের ক্ষতি হচ্ছে কিনা আমার জানা নেই। তবে আমরা সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা করছি।
এ বিষয়ে কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম গোলাম মোর্শেদ খাঁন বলেন, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব চুল্লির বিরুদ্ধে অচিরেই অভিযান চালানো হবে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গাজীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ মমিন ভূইয়া জানান, এসব অবৈধ কয়লা তৈরির চুল্লি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। অচিরেই অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ কয়লার চুল্লি বন্ধ করে দেওয়া হবে।