ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনায় শিশুমনে গভীর ক্ষত

করোনায় শিশুমনে গভীর ক্ষত

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে দেশে দেশে আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনও ঘটেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে ছিল না। দেশে করোনায় লকডাউনের মধ্যেও ঘরে নারী ও শিশুরা সহিংসতার শিকার হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এমনকি ঘরবন্দি অবস্থায় সামাজিক মাধ্যম কিংবা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে গিয়ে শুধু গৃহবধূই যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাই নয়, শিশুরাও নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে। তাছাড়া করোনার সময়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার যেমন বেশি ছিল, তেমনি বাল্য বিয়েরও ঘটনা ছিল বহু।

এবার আরেকটি গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভার্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)। গতকাল বুধবার রাজধানী ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে সংস্থাটির গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, করোনাকালে সমাজের ৪৬ দশমিক ৬০ শতাংশ কিশোরী সামাজিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আর কিশোরদের মধ্যে সহিংসতার শিকার হয় ৭২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। পারিবারিকভাবে সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২২ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। এই হারের মধ্যে কিশোররা ২৫ দশমিক ৫৩ ও কিশোরীরা ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

গবেষণায় আরও জানানো হয়, পরিবারের বাইরে ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ শিশু-কিশোর সহিংসতার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে কিশোর ৭২ দশমিক ৩৪ ও কিশোরী ৪৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। তাদের পরিবারের আয়ও কমে গেছে। এতে করোনা পরবর্তীতে অনেকে শ্রমে নিযুক্ত হয়ে গেছে। সহিংসতার শিকার হয়েছেন এমন ২৪ জন কিশোরী ১২ জন কিশোরের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। ১৫টি প্রশ্নের ভিত্তিতে তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। সেখানে স্কুল শিক্ষক, জেলা শিক্ষা অফিসার, প্রবাশন অফিসার, জেলার জজ, ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও অভুক্ত ছিল।

গবেষণায় বলা হয়, গাইবান্ধায় ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগেছে। তা ছাড়া করোনাকালে ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী লকডাউনে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়েছে। ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী ৩-৫ ঘণ্টা এবং ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ১ ঘণ্টার নিচে পড়ালেখা করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা মহামারিকালীন সংকটে দীর্ঘসময় স্কুল বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এসেছে। করোনার কারণে শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনো-সামাজিক টানাপোড়ন, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ- এমন বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। করোনার সময়ে শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবক ও কিশোর-কিশোরীদের নেয়া সিদ্ধান্ত তাদের ভবিষ্যতের পথকে প্রভাবিত করবে। শুধু তাই নয়, তাদের জীবিকা এবং প্রজননস্বাস্থ্যও এর দ্বারা প্রভাবিত।

‘কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটে কিশোরী মেয়েদের দুর্বলতা এবং পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণাটি করা হয় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের ৩টি জেলা গাইবান্ধা, কুমিল্লা ও নড়াইলের ২৬টি উপজেলার ২৭৫৪টি পরিবারের সাক্ষাৎকারভিত্তিক। গবেষণা বলছে, ৩৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মহামারীর আগে ৩-৫ ঘণ্টা পড়াশোনা করতো। মহামারীর সময়ে কিশোর-কিশোরীদের এই হার ১৪ শতাংশে নেমে গেছে। যদিও করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার খুব একটা বেশি নয় তবুও, অন্তত ৩৫ শতাংশ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, করোনার কারণে তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে ১৬ শতাংশ ঝরেপড়া কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে, তারা পড়াশোনার খরচই আর চালাতে পারছে না।

মহামারির আগে ও পরে বাল্যবিবাহের হারে সামান্য কিছুটা ব্যবধান দেখা যায়। ৫০ শতাংশ পিতামাতা জানিয়েছেন, মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে করোনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিলো। মেয়েদের ও তাদের পরিবারের সম্মানকে সুরক্ষিত রাখতে দ্রুত বিয়ে দিতে হবে- কোভিডের সময়ে প্রতিনিয়ত এমন সামাজিক চাপের মুখে ছিল কিছু পরিবার। ফলে সেসব পরিবার তাদের মেয়েদের বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

সমীক্ষা অনুসারে, বাল্যবিবাহ এবং স্কুল ছেড়ে দেয়ার পেছনে দারিদ্র্যের চেয়ে নিরাপত্তা এবং পারিবারিক সম্মান হারানোর ঝুঁকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল বন্ধের প্রেক্ষাপটে ছেলেদের কাজে পাঠাতে অভিভাবকরা সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিবেচনা এবং কেবল দারিদ্র্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

মিশ্র পদ্ধতির এই গবেষণাটি করা হয়েছিলো ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। কোভিড-১৯’র সংকট কিশোর-কিশোরীদের জীবনে কিভাবে পরিবর্তন এনেছে তা বিশ্লেষণ করা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে এদেশের নারী ও কিশোরীদের অবস্থা কেমন, বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা বোঝা ছিলো উক্ত গবেষণার লক্ষ্য।

বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিনের সঞ্চালনায় গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আইন সচিব মো. গোলাম সারওয়ার। আলোচনায় অংশ নেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সোশ্যাল সেফটি নেট উইং এর অতিরিক্ত সচিব এম এম মাহমুদুল্লাহ, ব্র্যাকের সাবেক শিক্ষাবিষয়ক পরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম, মহিলা পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সীমা মুসলেম, আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব উম্মে কুলসুম, বিআইজিডির রিসার্চ ফেলো মাহিন সুলতান, বিআইজিডির লপিতা হক প্রমুখ।

মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, আমাদের নীতিনির্ধারণে ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং একইসাথে মানুষের সক্ষমতা ও সুস্থতাকে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আরও স্থিতিস্থাপক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা প্রণয়নে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার এবং সুশীল সমাজ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। সেই ব্যবস্থাই আমাদের লিঙ্গ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে একটি মৌল মানবিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

উম্মে কুলসুম বলেন, এটি খুব সুস্পষ্ট যে সরকার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধারের কৌশল এবং লৈঙ্গিক সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন কাঠামোকে চিহ্নিত করেছে। আর এ গবেষণায় নারী ও কিশোরীদের যেসব সমস্যা উঠে এসেছে তা মোকাবিলায় এই কাঠামো বড় ভূমিকা রাখবে।

এম এম মাহমুদুল্লাহ বলেন, করোনা সময়ে ভার্চুয়াল কোর্টে শিশু উনয়ন কেন্দ্র থেকে১০০৩ জন শিশুকে জামিনের ব্যবস্থা করা হয়। করোনায় আক্রান্ত না হয়ে ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সরকারের এ ব্যবস্থানে ধন্যবাদ দিতে হয়। কেননা অন্যান্য দেশের তুলনায় মৃত্যু কম ছিল। খাদ্য ও নগদ অর্থসহযোগিতা উপকারে এসেছে। তিনি বলেন, সরকারের অনেকগুলো মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তায় কর্মসূচিতে যুক্ত। আর এটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে।

ড. ইমরান মতিন তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, কোভিডের সময়ে কিশোর-কিশোরীদের ব্যাপারে খুব একটা গবেষণা এবং নীতিনির্ধারণী আলোচনা হয়নি। অর্থনৈতিক কারণ ও স্কুল বন্ধ থাকা- এই দুইয়ে মিলে তাদের জন্য আগে থেকেই চলমান ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে এবং নতুন ঝুঁকির ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

মহিলা পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সীমা মুসলেম বলেন, করোনার অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছে নারী। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া ও বাল্যবিবাহে আবদ্ধ হয়েছে কোভিডকালীন সময়ে। কেননা বাল্যবিবাহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। সে নানা ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এসব কারণে সামাজিক সূচকে রাষ্ট্র পিছিয়ে যাচ্ছে।

বাল্যবিবাহ বন্ধ ও প্রতিরোধ দুটি আলাদা বিষয়। এটি বন্ধের চেয়ে প্রতিরোধে নানা ধরনের কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। এক্ষেত্রে জন্মসনদ ডিজিটাল করতে হবে। কেননা এসব মিথ্যার কারণে বয়স বাড়ানো হয় বলে তিনি জানান।

জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিএমজেড) এবং ইউকে ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)’র সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়নের অংশীদারিত্বের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে জার্মানি এই গবেষণার সহযোগী হয়।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন