রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধানসহ বিভিন্ন সড়কে জার্মানির কথা বলে চীনের তৈরি নিম্নমানের বাতি লাগানোর অভিযোগ উঠেছে। আট মাস না যেতেই বিকল হয়ে গেছে অনেক সড়কবাতি। ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কবাতি স্থাপন নিয়ে সমালোচনার পর অবশেষে প্রকল্পের পাঁচটি প্যাকেজের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে।
সূত্রমতে, সিটি করপোরেশনের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে বাতি স্থাপনের জন্য ৪৯ কোটি টাকার প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। এতে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও মেয়র মোস্তাফিজার রহমান সই করেন। পরে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জার্মানি অথবা ফ্রান্সের তৈরি ৩৬ ওয়াটের এলইডি বাতি স্থাপনের জন্য প্রকল্পের অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু ৩৬ ওয়াটের সঙ্গে ৬০ ওয়াটের বাতি সংযুক্ত করার জন্য একটি মহল উঠেপড়ে লাগে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজী শাহ আলম মেয়রের কাছে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ করেন, প্রকল্প অনুমোদনের ডিপিপিতে এলইডির দরপত্র অনুযায়ী ৩৬ ওয়াটের এলইডি বাতি কেনার কথা উল্লেখ থাকার পরও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত ডিপিপি অনুসরণ না করে ৩৬ ওয়াটের পরিবর্তে ৩৬/৬০ ওয়াটের বাতি অন্তর্ভুক্ত করে টেন্ডার আহ্বান করেন।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ৩৬ ওয়াটের পরিবর্তে ৩৬/৬০ ওয়াটের বাতি টেন্ডার শিডিউলে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি জানান। সেই সঙ্গে ডিপিপি অনুযায়ী টেন্ডার সংশোধন করে পুনরায় টেন্ডার আহ্বানের সুপারিশ করেন। কারিগরি কমিটির সুপারিশ অগ্রাহ্য করে সিটি মেয়র একক সিদ্ধান্তে ৩৬ ওয়াটের পরিবর্তে ৩৬/৬০ ওয়াটের বাতি লিখে টেন্ডার সংশোধনের নির্দেশ দেন। এভাবে টেন্ডার আহ্বানের আগেই পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় প্রকল্পের পাঁচটি প্যাকেজের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা কার্যাদেশ বাতিল করে চিঠি দিয়েছেন। তবে কার্যাদেশ বাতিলের পরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বাতি অপসারণ করেনি। উল্টো কার্যাদেশ বাতিল আদেশ প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করে ২০ কোটি টাকার বিল নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পিপিআর আইনে একবার কার্যাদেশ বাতিল করলে তা পুনঃকার্যাদেশ দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন।
সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এডেস্ক করপোরেশন নিম্নমানের এলইডি বাতি অপসারণ না করায় তার কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। কার্যাদেশ বাতিলের আদেশে যা বলা হয়েছে, মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা স্বাক্ষরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, প্যাকেজ নম্বর ১, ৩, ৭ ও ৮ ঠিকাদারি চুক্তি বাতিলকরণ প্রসঙ্গে জানানো যাচ্ছে, রংপুর সিটি করপোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন রাস্তায় সড়ক বাতি স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চারটি প্যাকেজের কাজের বিপরীতে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর চলতি বিল প্রদান করা হয়। এরপর ৯ ডিসেম্বর থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ রেখেছে। বর্ণিত প্যাকেজ বাস্তবায়নের অনুমোদিত মেয়াদ ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল। সম্পাদিত চুক্তির জিসিসি ক্লোজ নম্বর ৮৯.২ (বি) (১) মোতাবেক ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি কেন বাতিল করা হবে না’ মর্মে ২৮ দিনের মধ্যে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা চেয়ে ১৫ ডিসেম্বর স্মারক নম্বর ১৫১৪ মূলে একটি পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু ২৮ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জবাব দেয়নি।
এমনকি বৈদ্যুতিক পোলে স্থাপনকৃত স্পেকেশনবহির্ভূত বাতি অপসারণের জন্য ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর ও ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি দুটি পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের এলইডি বাতি অপসারণ করাসহ কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএফডির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-৩-এর গত ৯ মার্চ দেওয়া পত্রে সুপারিশগুলোর মধ্যে ২৪(খ) নম্বর সুপারিশে প্রতারণার দায়ে এডেস্ক করপোরেশনের বিরুদ্ধে পিপিআর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠায়। এ অবস্থায় এলইডি বাল্ব সরবরাহে প্রতারণার দায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা হলো।
এ বিষয়ে মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার রাস্তায় লাইট পোস্ট স্থাপন ও জার্মান অথবা ফ্রান্সের তৈরি এলইডি বাল্ব স্থাপনের চুক্তি করা হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের তৈরি নিম্নমানের বাল্ব স্থাপন করে। বিষয়টি পরীক্ষার জন্য বুয়েটে পাঠানো হলে তারাও পরীক্ষা করে বাল্বগুলো নিম্নমানের বলে প্রতিবেদন দেয়। সে কারণে তাদের দুইবার বাল্ব অপসারণের চিঠি দেওয়ার পরও তারা অপসারণ না করায় কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক