ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পর্যটনে সম্ভাবনাময় দিবর দিঘী

Dainikanandabazar
পর্যটনে সম্ভাবনাময় দিবর দিঘী

আমাদের দেশের অনাবিল গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য্যে দিগন্তজোড়া এক অন্যতম অনুসঙ্গ। চিরায়ত বাংলার রূপে সৌন্দর্য্যরে ভিন্ন মাত্রাযোগ করেছে দেশের সুবিশাল দিঘীগুলো। এ বাংলায় যেমন রয়েছে অনবদ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে ভান্ডার আর প্রাচীন স্থাপনা, তেমনি সেগুলোকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য উপকথা, লোককথা ও কল্পকাহিনী। তেমনি বিভিন্ন জেলায় এ দিঘীগুলোর সৌন্দর্য্যরে দারুণ নজরকাড়া। অপরূপ স্যেন্দর্য্যরে এ দিঘীগুলোর শীতল জলে মণপ্রাণ জুড়াতে কার না ভালো লাগে। তেমনি এক ঐতিহাসিক দিঘী হলে নওগাঁর দিবর দিঘী। অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর পুরাকৃর্তির নিদের্শনে ঘেরা এ দিঘীটিতে আসতে ভুলেনা কেউ।

নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলা থেকে প্রায় ১৬ কি.মি পশ্চিমে সাপাহার-নওগাঁ সড়কের পাশেই অবস্থিত ঐতিহাসিক দিবর দিঘী। দিবর দিঘীর ঐতিহাসিক পটভূমি ছাড়াও রয়েছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। দিঘীর মূল ঘাটে প্রবেশ করার সময় দুই পাশে উইপিং দেবদারু গাছ দিয়ে ঘেরা রাস্তা দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায়।

স্যার আলেক জ্যান্ডার ক্যানিংহাম ও স্যার বুকারন হ্যামিলটনের পরিদর্শন করা নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার ঐতিহাসিক দিবর দিঘী সঠিক উদ্যোগ নিলে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

ঐতিহাসিক দিবর দিঘীতে স্থাপিত প্রাচীন স্থাপত্য পুরাকির্তীর অনুপম নিদের্শন এবং হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির শৌর্য-বীর্জের প্রতিক হিসাবে কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আজও দন্ডায়মান দীঘির বিজয় স্তম্ভটি আর সেই নিদের্শনটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভীড় জমাচ্ছে পত্নীতলার ঐতিহাসিক এ স্থানে।

ইতিহাস সমৃদ্ধ দিবর দিঘী বরেন্দ্র ভূমি নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নের দিবর নামক গ্রামে অবস্থিত। দিঘীটিকে ঘিরে লোকমুখে অনেক কল্পকাহিনী বা কাল্পনিক গল্প কথা প্রচলিত আছে। এলাকার প্রবীন ব্যক্তিদের মতে জৈনক বিষু কর্মা নামক একব্যক্তি এক রাতে এবং অন্যান্যদের মতে জীনের বাদশাহর হুকুমে এব রাতে বিশাল আকৃতির এ দিঘীটি খনন করা হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, দিবর বা ধীবর নামে পরিচিতি এ বৃহৎ জলাশয় ও জলাশয়ের মাথখানে অবস্থিত স্তম্ভটি একাদশ শতাব্দীর কৈবত্য রাজা দিব্যক তার ভ্রাতা রুদ্যোকের পুত্র প্রখ্যাত নৃপতি ভীমের কির্তী হিসাবে পরিচিত।

ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, পাল রাজার দ্বিতীয় মহিপালের (১৭৭০-১৭৭১ খ্রি) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বরেন্দ্র ভূমির অধিকাংশ অমত্য পদচ্যুত সেনাপতি বরেন্দ্র ভূমির ধীবর বংশভূত কৃতি সন্তান দিব্যকের নেতৃত্বে পাল শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় মহিপালকে হত্যা করেন।

পরে সর্বসম্মতিক্রমে দিব্যককে বরেন্দ্র ভূমির অধীপতি নির্বাচিত করা হয়। কিছুকাল পরে দিব্যক মিত্যুবরণ করলে প্রথমে রুদ্যোক পুত্র ভমি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনিই একমাত্র কৈবত বংশীয় রাজা যিনি প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছর বরেন্দ্র ভূমি শাসন করেন। এর পরে দ্বিতীয় মহিপালের ভ্রাতা রামপাল ভীমকে পরাজিত ও নিহত করে রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। তবে কোনো কৃতি কৈবত রাজা বিজয় স্তম্ভটি নির্মাণ করেছিলেন তা আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে জানা যায় নি।

প্রায় ৩০ ফুট লম্বা একটি অখণ্ড পাথর কেটে তৈরী এ স্তম্ভের ৯টি কোন আছে। এর এক একটি কোণ থেকে অন্য কোণের দূরত্ব প্রায় ১২ ইঞ্চি। এ বিজয় স্তম্ভের উপরিভাগে পর পর তিনটি বল আকারে স্মৃতি রেখা আছে। যা স্তম্ভের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে। এর শীর্ষ দেশ নান্দনিক কারুকার্য খচিত মুকুটাকারে নির্মিত।   

বর্ণনা মতে পানির উপরিভাগে স্তম্ভের উচ্চতা ১০ ফুট, পানির ভিতর ১০ ফুট এবং মাটির নিচে সম্ভবত আরো ১০ ফুট গথিত আছে। স্যার বুকানন হ্যামিলটনের মতে স্তম্ভটির দৈর্ঘ্য ৩০.৩৪ ফুট। অপর দিকে স্যার আলেক জেন্ডার কানিংহামের মতে দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট। স্যার আলেকজেন্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সনে যখন এ দিঘী পরিদর্শনে আসেন তখন এর গভীরতা ছিলো ১২ ফুট এবং এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ছিলো ১২শ ফুট। বিজয় স্তম্ভটির শীর্ষদেশে মূল্যবান বস্তু আছে ভেবে কয়েক যুগ পূর্বে এর শীর্ষদেশের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। কথিক আছে তারা প্রত্যেকেই দিবর দিঘীতে ডুবে মারা গেছেন।

যুগ যুগ ধরে দখলবাজদের কারণে দিবর দিঘীর অনেক সরকারি সম্পত্তি বেদখল হয়েছে। বর্তমানে দিবর দিঘীর জলাশয়ের পরিমান প্রায় ২০ একর। এ জলাশয় টুকুই সরকারি সম্পত্তি হিসাবে বজায় আছে। মাছ চাষের জন্য লিজ দিয়ে সরকার প্রতিবছর দীঘি থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করছে। ঈদের দিন ও তার পরবর্তী সাত দিন সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটে। তবে এখানে সংস্কারের কোনো কাজ চোখে পড়ার মতো না।

সংবাদটি শেয়ার করুন