জরাজীর্ণ ভবন। খসে পড়ছে পলেস্তরা। দেয়ালে শ্যাওলা বেঁধেছে। চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ। লোকজনের বসবাসও রয়েছে। তবুও প্রবেশ করলেই গা ছমছম করে উঠবে। দেখে মনে হবে যেনো ভূতুড়ে বাড়ি। বলছি রূপগঞ্জের ২০০ বছরের পাল বাড়ির কথা। পাল রাজবংশের রাজা-জমিদাররা এ বাড়ির গোড়পত্তন করেছেন। ভোলাব ইউনিয়নের চারিতালুক পাল বাড়ি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা হলেও প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কারো দৃষ্টি পড়েনি। বাড়িটি রক্ষাণাবেক্ষণে খোদ উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নেয়নি। রক্ষাণাবেক্ষণ করা হলে বাড়িটি পর্যটন এলাকা হিসাবে পরিচিতি পেতো।
উর্বর পলি মাটির জমিন আর সবুজ বৃক্ষরাজির ছায়ায় ঘেরা ভোলাব ইউনিয়ন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমাখা ভোলাবতে রয়েছে সুলতানি আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন আমল পর্যন্ত নির্মিত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, মন্দিরসহ নানান কীর্তিমাখা স্থাপনা। এইসব স্থাপনা ভোলাবোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকেও বাড়িয়ে তুলেছে। চারিতাকুল পাল বাড়ি ভোলাবর তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা।
ভ্রমণ বিষয়ক বিভিন্ন বই পুস্তকে দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে দর্শনীয় স্থানের তালিকায় থাকা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চারিতালুকের পালবাড়িটি জরাজীর্ণ হওয়ায় বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়,রূপগঞ্জ উপজেলার ভোলাবো ইউনিয়নের অধীনে মোচার তালুক মৌজার চারিতালুক গ্রামে রয়েছে একটি প্রাচীন দালান। ৩১ শতক জমির উপর দ্বিতল ভবনে পুরানো স্থাপত্যের নিদর্শন নিয়ে কালের বিবর্তে জরাজীর্ণ আর অরক্ষিত অবস্থায় দাঁড়িছে আছে।
অপরদিকে পাল সাম্রাজ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের পরবর্তী ধ্রুপদি যুগের একটি সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের উৎসস্থল ছিল বাংলা অঞ্চল। পাল সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় এই সাম্রাজ্যের শাসক রাজবংশের নামানুসারে। প্রাচীন প্রাকৃত ভাষায় এই শব্দটির অর্থ ছিল ‘রক্ষাকর্তা’। তাদের রাজত্বকালেই প্রাচীন বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে। খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে হিন্দু সেন রাজবংশের পুনরুত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তবে বাংলার ইতিহাসে পাল যুগকে অন্যতম সুবর্ণযুগ মনে করা হয়। বাংলার প্রথম সাহিত্যকীর্তি চর্যাপদ পাল যুগেই রচিত হয়েছিল।
ওই পাল রাজাদের বংশধর ও জোতদারদের কালের বিবর্তে বিদায় ঘন্টার পর রূপগঞ্জের এ ভোলাবো অঞ্চলে বিনিময় দলিলের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদ থেকে এসে প্রায় ২৬টি পরিবার বসবাস শুরু করেন। এ পালবাড়িটি দেশের দর্শনীয় স্থানের একটি ।
প্রবীণ বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বাড়িটি বৃটিশ আমলে অভিজাত জমিদারদের আবাসস্থল ছিল।যেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন শাসক পাল রাজাদের বংশধররা ও জোতদাররা বসবাস করতেন। জোতদাররা ছিলেন পাল রাজার অধীনস্থ জমিদার। তবে জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হলে কিংবা ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর ওই পালরা এখানকার জমিদারী ও ঘরবাড়ি ফেলে চলে যায় ভারতের মুর্শিদাবাদ ও কলকাতাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে।
এসব বিষয়ে কথা হয় পালবাড়িতে বসবাসরত ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ হাজী আমানুল্ল্যাহ আামনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় বাংলাদেশে অস্থায়ীভাবে আমাদের পিতা আহসান উল্লাহ খান মাস্টার প্রথম আসেন। সে সময় আমরা মুর্শিদাবাদের জালালপুর গ্রামে বসবাস করতাম। তখন এ বাড়িটির জৌলুস ছিলো। দর্শনার্থীরাও আসতেন দেখতে। এ বাড়ির তৈরী সন বিষয়ে কোন তথ্য পাইনি। তাই আমরাও কৌতুহলী হয়ে আশপাশের শতবর্ষি প্রবীণ বাসিন্দাদের কাছে এ পুরাতন ভবনের তৈরী সময় ও ইতিহাস জানতে চাইতাম। তবে তারাও তাদের শৈশব থেকে এ ভবনকে এমনই দেখেছেন বলে দাবী করেন।
তিনি আরো বলেন, ভবনটি প্রায় ২’শ বছরের পুরনো হবে। বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এ ভবন দেখতে আসেন। আশপাশে বাড়িঘর থাকায় দর্শনার্থীরা আসলে অসুবিধা হয়। তবে প্রত্নতত্ত বিভাগ রহস্যজনক কারনে এসব পুরানো ভবন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। এতে প্রাচীন ঐতিহ্য বিলিনের পথে।
এদিকে খোঁদ উপজেলা প্রশাসনের কাছে তথ্য নেই এ ভবনের ঐতিহাসিক রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশনার। ভোলাবো ইউনিয়ন উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (সহকারী নায়েব) সঞ্জয় কুমার বলেন, এটা আরএস রেকর্ডীয় সূত্রে ব্যক্তিগত মালিকানার জমিতে অবস্থিত। যারা বসবাস করছে তারা বিনিময় দলিলের মাধ্যমে বৈধভাবে মালিক হয়ে বসবাস করছেন বলে জানি। ফলে তা সরকারীভাবে সংরক্ষনের উপায় নেই।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলাম বলেন, চারিতালুকের পাল বাড়িটি বিষয়ে জেনেছি। এটা ঐতিহাসিক নিদর্শন। উর্ধ্বতন মহল ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানিয়ে এটাকে সংরক্ষনের জন্য খুব শীঘ্রই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে চিঠি বিনিময় করে ব্যবস্থা করবো।