- শ্রমিক-সংকটে কৃষক, মেঘ দেখলেই ভয়
দেশের খাদ্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত নওগাঁয় এবার বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্লাষ্টরোগের আক্রমণ আর শ্রমিক সংকট সব মিলিয়ে হতাশায় পড়েছেন এ জেলার কৃষকরা। কিছু দিন ধরে চলা বৈরি আবহাওয়ার কারণে নুইয়ে পড়েছে অধিকাংশ মাঠের ধান গাছ। পানি জমে গেছে ধান ক্ষেতে। নুইয়ে পড়া ধান ক্ষেতে দেখা দিয়েছে ব্লাস্টরোগ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন কৃষকেরা। এ দিকে চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশ ধান উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষিবিভাগ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ লাখ মেট্রিকটন। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এ জেলায় প্রায় ৯০ শতাংশ ধান পাকলেও ধান কাটা হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। বৈরি আবহাওয়ার কারণে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে সোনালী রং এর ধানগুলো মাটিতে নুইয়ে পরে আছে। অনেক ক্ষেতে বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে। পানি জমে থাকায় ধান থেকে পূনরায় নতুন করে ধনের চারা গজাতে দেখা যাচ্ছে। নুইয়ে পড়া কোনো কোনো ধান ক্ষেতে ব্লাস্টরোগের কারণে ধান চিটা হয়ে গেছে। গাছের ওপরের দিকটা মরে সাদা হয়ে গেছে।
কৃষকরা বলছেন, শ্রমিক সংকটের কারনে তাঁরা ধান কাটতে পারছেন না। যাও মিলছে নুইয়ে পড়া ধানক্ষেত দেখে তারা আর কেও কাটতে আগ্রহ হচ্ছেন না। যারা কাটবেন বলছেন তাদের মুজুরি চাহিদা দ্বিগুণ। বেশি মুজুরি দিয়ে ধানকেটে ঘরে তুলে কিছুই থাকছে না তাদের। বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটার পর দেখা যাচ্ছে, গত বছর যেই সব জমিতে ২৫ থেকে ৩০ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে, এবার সেই জমিতে ২০ মণ এরও কম উৎপাদন হচ্ছে।
মহাদেবপুর উপজেলার শালবাড়ী গ্রামের কৃষক মোরশেদ আলম বলেন, ‘এবার ১০ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছি। এক সপ্তাহ আগে ক্ষেতের সব ধান পেকে গেছে। তবে শ্রমিক না পাওয়ার কারণে এক বিঘা জমির ধানও ঘরে তুলতে পারিনি। অন্য বছর বাইরের জেলা থেকে অনেক শ্রমিক আসে। তবে এবার বাইরের জেলা থেকে শ্রমিক এসেছে খুব কম। এদিকে ক্ষেতের ধান ডুবে যেতে বসেছে। ধান নিয়ে এবার মহাবিপাকে পড়েছি।’ তিনি আরোও বলেন, গত বছর ধানকাটা শ্রমিকদের মোট ধানের ৫-৬ শতাংশ দিলেই হতো। এতে প্রতি বিঘা জমির ধান কাটা বাবদ খরচ পড়তো প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। তবে এবার এপ্রিল মাঝামাঝি সময়ে হয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ে খেতের ধানগাছ নুইয়ে পড়ায় ধান কাটতে বেশি শ্রম লাগায় ধানকাটা শ্রমিকেরা মোট ধানের ৮-১০ শতাংশ দাবি করছে। কৃষকেরা তাদের দাবি অনুযায়ী ধান কাটতে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন। এতে চলতি বছর এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
নওগাঁর সদর উপজেলার দুবলহাটি গ্রামের বাসিন্দা নবির উদ্দীন বলেন, তার নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ৫ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। সেচ খরচ, সার ও পরিচর্চা বাবাদ প্রতি বিঘা জমিতে ৮ থেকে ৯ হাজার করে টাকা খরচ হয়েছে। তারপর ঝড়ে খেতের ধান নুইয়ে পড়া ও ব্লাস্ট রোগের আক্রমনে খেতের ১০-১২ শতাংশ ধান চিটা হয়ে গেছে। আবার শ্রমিক খরচ পড়ছে প্রতি বিঘায় প্রায় ৫ হাজার টাকা। জমির মালিককে অর্ধেক দিয়ে সব খরচ বাদ দিয়ে দেখা যাচ্ছে কিছুই থাকছে না।
গতকাল বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখানো হাজার হাজার একর জমির পাকা ধান মাঠে পড়ে আছে। শ্রমিকের অভাবে এসব ঘরে তুলতে পারছেন কৃষকেরা। অনেক কৃষক পরিবারের সদস্য নিয়ে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করছেন।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ বলেন, মাঠে প্রায় শত ভাগ ধান পেকে গেছে। আমরা কৃষকদের দ্রুত মাঠের ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছি। তবে বৈরি আবহাওয়ার কারনে অনেক মাঠে নুইয়ে পড়া ধান শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষকেরা কাটতে পারছেন না। বাইরের জেলার শ্রমিক কম আসায় শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। সময় মত ধান ঘরে তুলতে না পাড়লে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিবে। ঝড়-বৃষ্টি ও শেষ সময় ব্লাস্ট রোগের আক্রমনে এবার এ জেলায় লক্ষ মাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ ধান উৎপাদন কম হতে পারে বলেও তিনি জানান।