ঢাকা | শনিবার
১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
২রা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্রোতস্বিনী এখন রূপকথা

স্রোতস্বিনী এখন রূপকথা

‘নদীর বুকে চলবে গাড়ি, সেই দিন বেশি দূরে নয়’ গানের কথাগুলো যেন আজ সত্যি হওয়ার উপক্রোম। নওগাঁ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে এখন নামেই নদী, বাস্তবে পরিণত হয়েছে মরাখালে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যখন বন্যার কবলে ঠিক তখনও পানিশূন্য হয়ে পড়ে আছে মহাদেবপুর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের উত্তাল আত্রাই নদীসহ নওগাঁ জেলার প্রধান প্রধান ৫ নদী। নদীগুলো শুকিয়ে এখনই যে অবস্থায় এসেছে তাতে এসব নদী রক্ষার কার্যকরী উদ্যোগ না নিলে আগামী দিনগুলোতে এসব নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়বে।

পলি পড়ে ও চর জেগে নাব্যতা হারিয়েছে অধিকাংশ নদী। এখন সামান্য জোয়ার হলেই নদীর দু-কূল উপচে পানি ঢুকে পড়ে গ্রাম ও চরগুলোতে। সামান্য জোয়ারেই দেখা দেয় প্লাবন। নষ্ট হয় ফসলি জমি। নদীর এ বেহাল দশায় হুমকির মুখে পড়েছে নৌপথ। চাষাবাদও আর আগের মতো করতে পারছেন না কৃষকরা। লোকসান পুষিয়ে নিতে স্রোতস্বীনি নদ-নদীর মরাদেহে ইরি-বোরোর আবাদ শুরু করেছে কৃষক। অথচ এক সময় এসব নদ-নদী ছিল উত্তাল। নদীগুলোর বুক চিরে চলাচল করতো বড় বড় লঞ্চ, স্টিমারসহ শত শত পালতোলা নৌকা।

দেশের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ও পণ্য আনা-নেয়ার জন্য এ নদীগুলোই ছিল একমাত্র ভরসা। পানির অভাবে নদীগুলো এভাবে শুকিয়ে যাওয়ায় এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে কৃষি, মৎস্য ও বৃক্ষসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও। নওগাঁর নদীগুলোর মধ্যে প্রধান পাঁচ নদীরই এ করুণ দৃশ্য অবলোকন করে এলাকাবাসী হতাশ হয়ে পড়েছেন। এক সময় উত্তাল থাকা এ নদীগুলো হচ্ছে মহাদেবপুর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত আত্রাই, সাপাহার উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত পূর্ণভবা, বদলগাছী উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ছোট যমুনা, আত্রাই উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত নাগর ও জেলা সদরের উপর দিয়ে প্রবাহিত তুলসীগঙ্গা। নদীগুলোতে এক সময় ঢেউয়ের তালে অসংখ্য পালতোলা নৌকা চলাচল করলেও এখন কোথাও বিরাজ করছে হাঁটু পানি, কোথাও ধূ-ধূ বালুচর।

আত্রাই নদীর খেয়া পাড়ের মাঝি লোকমান হোসেন জানান, বাপ-দাদার সময় এই নদীই ছিল তাদের বসত বাড়ি। সারা দিন-রাত নদীর বুকে নৌকা বেয়ে জাল দিয়ে মাছ ধরে তা বিক্রি করেই চলত সংসার। তখন নদীতে মাছের কোন অভাব ছিল না। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল হাজারও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সারা দিন নদীর উপর দিয়ে শত শত পালতোলা নৌকা বয়ে যেত। বর্তমানে নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ায় নদীতে আর মাছ হয় না। দেখা যায় না পালতোলা নৌকা। নদীমাতৃক এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে জেলার ব্যবসা বাণিজ্যের এক সময়ে যে যৌবন ছিল তাতে ভাটা পড়েছে। নদীগুলোর এই বেহাল দশায় নদীনালা বেষ্টিত বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো ঐতিহ্য হারাচ্ছে। বছরের পর বছর প্রকল্পভুক্ত বিস্তীর্ণ ফসলি জমি অনাবাদী থাকায় উৎপাদন কমে গেছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আমিমুল এহসান জানান, ড্রেজিংয়ের অভাবে ও পলি জমে নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় মৎস্য সম্পদও উজাড় হতে চলেছে। মিঠা পানির কমপক্ষে ৪৬ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। ফলে জেলে সমপ্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ পেশা হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। শুধু মৎস্য উৎপাদনেই নয় এর প্রভাব পড়েছে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষেত্রেও। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অতি শীগ্রয় নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলেও তিনি জানান।

এ বিষয়ে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারী জানান, “নদী আমাদের মা, নদীকে বাচায় পরিবেশকে বাঁচায়” এই স্লোগান নিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই নদী রক্ষায় সচেতনতা মূলক লিফলেট বিতরণ, মানববন্ধনসহ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি বহুবার। কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে শিল্পীর ভাষায় বলতে হয় “এই খানে এক নদী ছিল জানলো না তো কেউ” আগামী প্রজন্ম সত্যিই এই নদীগুলো আর দেখতে পাবে না। তাই নদীগুলোকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখনি প্রয়োজন।

তিনি আরোও বলেন, প্রতিবেশী দেশের নির্মম পানি আগ্রাসনের ফলেই এক সময়ের খরস্রোতা এসব নদী ক্রমেই এমন করুণদশায় এসে ঠেকেছে। এদিকে সরকারী নজরদারীর অভাবে এক শ্রেণির ভূমিদস্যু নদীগুলোর অনেক স্থান দখলে নিয়ে খুশিমতো ভরাট করে ফেলেছে। অনেকে নদীগুলোর মাটি বিক্রির প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। অনেক স্থানে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা নদী দখলে নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করে নদীর শেষ চিহ্নটুকুও মুছে ফেলতে চাইছে। এতে নদীগুলোর মূল সীমানাও হারিয়ে যেতে বসেছে। নদীগুলোর করুণদশা হলেও প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে নদীগুলো সম্পূর্ণরূপেই অস্তিত্ব হারাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই শিগগিরই ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে একসময় এসব নদী দেশের মানচিত্রে থাকলেও বাস্তবে ফসলের মাঠ হিসেবেই দেখবে আগামী প্রজন্ম।

এব্যপারে নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশুলী আরিফউজ্জামান খান জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব নদীর পানি প্রবাহের প্রধান উৎস পদ্মা ও মেঘনাসহ ভারতের আগ্রাসন থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উজানের নদীগুলোতে তীব্র পানি সংকট দেখা দেয়ায় এসব নদ-নদীগুলোর এ বেহাল দশা হয়েছে। এছাড়াও ড্রেজিংয়ের অভাবে নদীগুলোর চর অপসারণ করা সম্ভব না হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নদী ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ দিলেও নদী রক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। ফলে একদিকে ভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না অপরদিকে নদীও রক্ষা করা যাচ্ছে না। তবে বর্তমান সরকার এসব নদী ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। খুব শিগগিরই তা কার্যকর হবে।

বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, নদী রক্ষায় বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে এর ধারাবাহিকতায় মন্ত্রণালয় বরাবর একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আশা করছি প্রস্তাবনা পাস হলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন