ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কার ক্ষতি কার লাভ

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় খাবার দোকানের তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ঘটে যাওয়া প্রাণঘাতী সংঘর্ষ
  • গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলার নেপথ্যে কারা

লাভ-ক্ষতি

  • দুদিনে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি
  • খুলেছে মার্কেট, কমেনি আতঙ্ক
  • নিহত দুজনের পরিবারে মাতম
  • তিন মামলায় আসামি ১৪০০
  • শিক্ষার্থীদের শতবছরের ক্ষতি

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় খাবার দোকানের তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ঘটে যাওয়া প্রাণঘাতী সংঘর্ষ নিয়ে নানা আলোচনা বিতর্ক চলছে। থেমে থেমে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা সংঘর্ষ রণক্ষেত্রে রূপ নেয়ার আগে কেন নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে নিউমার্কেটসহ এর আশপাশের বিপণিনগুলোর কর্মচারী আর ব্যবসায়ীরা কেন উন্মাদনায় মেতে থাকলো, কেনই বা শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করা গেল না তা নিয়ে বহুমুখী বিশ্লেষণ চলছে।

কোনো বাধা বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে চলা সংঘর্ষে ঈদবাজারে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের নিয়ে নানামুখী প্রচারণায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেবে। ক্রেতার সমাগম কমতে পারে আশঙ্কাজনক হারে। এতে সংঘর্ষকালীন ক্ষতির সঙ্গে আরো বড় ক্ষতি যুক্ত হতে পারে। এমন আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদেরও পড়তে হতে পারে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ক্লাস, পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এতে বড় ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এর ওপর বহু শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন কলেজ কর্তৃপক্ষসহ অভিভাবকরা। সংঘর্ষের ঘটনার পর পড়াশুনায় মনোযোগী হতে পারছেন না কেউই।

ইতোমধ্যে এর মধ্যে আবার সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। যেখানে অজ্ঞাতনামা প্রায় ১৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার ভয়ে থাকতে হতে পারে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও। সংঘর্ষের ঘটনায় একজন দোকান কর্মচারী ও কুরিয়ার সার্ভিসের এককর্মীসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তুচ্ছ ঘটনা থেকে এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। প্রশ্ন উঠেছে- ভয়াবহ এই ক্ষতিতে কার লাভ হলো?

ব্যবসায়ীরা এখন ভাবতে শুরু করেছেন তাদের আগামীর দিনগুলো নিয়ে। তারা বলছেন, এই এলাকার ব্যবসায়ীদের নিয়ে যেভাবে নেতিবাচক প্রচারণা হয়েছে, তাতে ক্রেতাদের আবারও নিউমার্কেটমুখী হতে অনেক সময় লাগবে। ঈদে ক্রেতাসঙ্কটে ভুগতে হবে বলেও মনে করছেন তারা। যেখানে দিনে শতকোটি টাকার বেচাকেনা হতো এখন সেটা তলানীতে গিয়ে ঠেকবে। এতে বর্তমান ক্ষতির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির যোগ হয়ে বড় ধরনের ক্ষতির হিসাব করতে হবে ব্যবসায়ীদের।

সংঘর্ষের দীর্ঘসময় জুড়ে দর্শকের ভূমিকায় নিষ্ক্রিয় থাকা পুলিশ এখন উসকানিদাতাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। তারা বলছে, সংঘর্ষের নেপথ্যে একাধিক গোষ্ঠির উসকানির অভিযোগ পেয়েছে তারা। ঢাকা কলেজের বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একইসঙ্গে নিউমার্কেট এলাকা থেকে বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে- তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ফুটেজে ঘুরে ফিরে বেশ কয়েকজন যুবককে মারমুখি দেখা গেছে। তাদের সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সন্দেহভাজন অন্তত ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

যদিও গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল অবধি কাউকেই শনাক্ত কিংবা আটক করতে পারেনি পুলিশ। সংঘর্ষের ঘটনায় বিস্ফোরক আইন ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে যে দুটি মামলা করা হয়েছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে আগামী ৭ জুন সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন আদালত। তবে মামলায় নিউমার্কেট থানা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুলকে আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে ঘটনা ভিন্নদিকে মোড় নেবে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।

এদিকে, নিউমার্কেটসহ আশপাশের সব দোকানপাট টানা দুইদিন বন্ধ থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকেখুলতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোলা হয় পুরো মার্কেট। নিউমার্কেটের রাস্তার ওপর থাকা দোকানগুলোও বিছিয়েছেন দোকানীরা। ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেছেন, রাতে ছাত্র, ব্যবসায়ী, শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ঢাকা কলেজ প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এক যৌথ বৈঠকে সমঝোতা হয়েছে। দোকানপাট আগের মতোই খুলবে। তারা তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাবে। এখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সবকিছু করা হচ্ছে।

সূত্রমতে, নিউমার্কেট ও আশপাশের ৩৪টি বিপণিবিতানে ১৪ হাজারের মতো দোকান আছে। ঈদের মৌসুমে সংঘর্ষের ঘটনায় ব্যবসা বন্ধ থাকায় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুদিনে তাদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তবে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হলেও কেনাবেচা নেই তেমন একটা। কয়েকজন ক্রেতা বলছেন, তারা অনেকটাই আতঙ্কে রয়েছেন, কখন আবার সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। আরেক ক্রেতা বলেন, আজ দোকান খুলবে কি না নিশ্চিত ছিলাম না। এখনও ভয় কাজ করছে। দেখছি দোকান খোলা আছে, তাড়াতাড়ি কেনাকাটা করে চলে যাব।

এক দেকানকর্মী বলেন, মঙ্গলবার এবং বুধবার দোকান বন্ধ ছিল। আজও (গতকাল) প্রায় দুপুর পর্যন্ত বন্ধ ছিলো। দোকান খোলার পর মাত্র দুজন ক্রেতা এসেছেন। একজনের কাছে বিক্রি করতে পারিনি, আরেকজনের কাছে মাত্র একটি পণ্য বিক্রি করতে পেরেছি।’ তার দাবি, সংঘর্ষের এ ঘটনায় দোকান বন্ধ থাকায় দোকানের প্রায় দুই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এরকম ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে সব দোকান মালিককে।

এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী সংঘর্ষ চলাকালে ঢাকা কলেজের তিনশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অর্ধশতাধিক। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন চার জন। এদের মধ্যে স্কয়ার হাসপাতালে একজন, গণস্বাস্থ্যে একজন, ঢাকা মেডিকেলে দুজন। চিকিৎসা খরচ বাবদ খরচ হচ্ছে কয়েক লাখ টাকা। ইতোমধ্যে গুরুতর আহত ছাত্র আশরাফের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধামন্ত্রী।

এ বিষয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্র প্রতিনিধি মহিউদ্দিন শিকদার লিপু দৈনি আনন্দবাজারকে বলেন, সংঘর্ষে মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তা শত বছরেও কাটিয়ে উঠা যাবে না। আমাদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক। এছাড়া আামাদের অসংখ্য ছাত্র আহত হয়েছে। ছোটখাটো আঘাত হিসেব করলে আহতের সংখ্যা তিনশতাধিক। এদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়েছে অনেকে। এখনো চারজন হাসপাতালে ভর্তি আছে। এই দুদিনে আমরা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। গত বুধবার সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করতে করতে সাহরি পর্যন্ত করতে পারিনি। তবে একটা সমাধানে আসতে পেরেছি বলে কিছুটা সান্ত্বনা পাচ্ছি।

নিউমার্কেট এলাকায় ভয়বহ সংঘর্ষের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের অতি বাড়াবাড়ি, উভয় পক্ষের মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাব, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, পুলিশের ভূমিকা, জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছি। সর্বোপরি প্রাণঘাতী এই সংঘর্ষে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা সবাই স্বীকার করেছেন। তবে এতে কার লাভ হলো সেটাই বড় কথা। যাদের কারণে তুচ্ছ ঘটনা প্রাণঘাতী হয়ে উঠলো, গণমাধ্যমকর্মীদের নির্মমতার শিকার হতো হলো, তারা আসলে কারা?

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন