ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রোগী বহনে ফাঁদ

রোগী বহনে ফাঁদ

ঘটনাটা রাজধানীর কাকরাইলে। ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালের গেটে। সময় ৩০ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে রোগী দেখিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন রোগীর স্বজনরা। অপরিচিত এক লোক এসে হাজির স্বজনদের কাছে। চুলগুলো এলোমেলো, পরনে পুরনো শার্ট। পায়ে এক জোড়া পুরাতন সেন্ডেল। রোগীর স্বজনদের বললেন, গাড়ি (অ্যাম্বুলেন্স) লাগবে? নিজেদের ব্যবস্থা করা গাড়ি আছে বলে তাকে বিদায় করা হয়।

এর মধ্যেই আগে থেকে ঠিক করা অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছে হাসপাতাল গেটে। তবে হঠাৎ করেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় রোগীর স্বজনদের। তিন চারজন যুবক এসে রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে বাধা দেয়। তারা কোনোভাবেই রোগীকে নিয়ে যেতে দেবে না। সেই যুবকদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে সেই এলোমেলো চুলের লোকটি। অ্যাম্বুলেন্সটি তারা আটকে দিলেও পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে হাসপাতালের আনসার সদস্যরা। এক কথা দুই কথার পর রীতিমত বাকবিতণ্ড শুরু হয়। স্বজনরা বুঝতে পারছিলেন না কেন অ্যাম্বুলেন্সটি তারা আটকে দিল? কেন তারা রোগী নিয়ে বের হতে দেবেন না?

বিতণ্ডার এক পর্যায়ে রোগী বের করতে বাধা দেয়া সেই যুবকদের একজন বলে উঠলেন, আমরা দাড়িয়ে থেকে ভাড়া পাচ্ছি না। আর বাইরের অ্যাম্বুলেন্স এসে রোগী নিয়ে যাবে তা হবে না। আমরা যেতে দেব না। এসময় রোগীর এক স্বজন জানতে চাইলেন, হাসপাতালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নেয়া যাবে না- এমন কোনো আইন বা নিয়ম আছে কিনা? এসময় মো. সরোয়ার জয় নামে এক যুবক বললেন, হ্যাঁ, নিয়ম আছে। এক হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স অন্য হাসপাতালের রোগী বহন করতে পারবে না।

কে এই নিয়ম করেছে? জানতে চাইলে সরোয়ার জয় বললেন, বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতি ও ঢাকা মহানগর সমিতি থেকে হাসপাতাল ভাগ করে দেয়া আছে। এসব সমিতির সদস্যদের একেকজন একেক হাসপাতালে ডিউটি করে। তারা এক হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে অন্য হাসপাতালের রোগী বহন করতে দেন না। সেইটা এখানকার নিয়ম।

সরোয়ার জয়ের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, হাসপাতালগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এসব সমিতির নেতারা। নানাজনের সুপারিশে বাইরের দুয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে যেতে পারলেও আর কিছুদিন পর তা আর পারবে না। কারণ ব্যাখ্যা করে সরোয়ার জয় বলেন, ‘ঢাকা থেকে আমরা যখন রোগী নিয়ে বিভিন্ন জেলায় যাই, সেসব জেলা থেকে আমাদের রোগী নিয়ে ঢাকায় আসতে দেয়া হয় না। তারা রোগী নামিয়ে রেখে দেয়। তাই আমরাও তাদের নিতে দিচ্ছি না।

লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা রোগী সিরাজুল ইসলামের স্বজনরা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমরা ৫ হাজার টাকা ভাড়ার চুক্তিতে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে এসেছি। রোগীকে ডাক্তার দেখিয়ে এখন যার অ্যাম্বুলেন্সে এসেছি তাকে নিয়েই ফেরত যাবো। তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন লোক বাধা দিচ্ছে। তাদের অ্যাম্বুলেন্স না নিলে তারা কোনোভাবেই যেতে দেবে না। পরে তাদের হাতে ৫০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে কোনোমতে হাসপাতাল থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোগীর স্বজনদের দেয়া সেই ৫০০ টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের সদস্য সরোয়ার জয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জয় বলেন, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে তারা আমাদের অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগী নামিয়ে রেখে দেয়। আমরা তো শুধু টাকা নিয়েই ছেড়ে দিয়েছি। তবে তিনি বলেন, এই টাকাটা আমরা খাবো না। গরীবদের দান করে দেব।

একই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী তানিম হোসেন নামে একজন। তার ঘটনাস্থল ছিল সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। সেখানে এক সিন্ডিকেটের কবলে পড়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আমার ছোট ভাই ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর পর অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে যাবো এমন সময় কয়েকজন আমাদের ঘিরে ধরেন। নিজের ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্স থাকা সত্ত্বেও তারা যেতে দিচ্ছিল না। অনেক বাকবিতণ্ডার পরেও কোনোভাবেই যেতে পারছিলাম না।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র ভাইয়ের সহযোগিতা চান তানিম। যিনি ওই হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তাকে ফোন দেয়ার পর তিনি ঘটনাস্থলে এসে সেই সিন্ডিকেটের কবল থেকে তানিম ও তার ভাইকে উদ্ধার করেন। এ ব্যাপারে তানিম হোসেন বলেন, পরিচিত লোক থাকায় আমরা না হয় আসতে পেরেছি, যাদের পরিচিত কেউ নেই তারা কীভাবে সিন্ডিকেটের কবল থেকে রক্ষা পাবেন? তিনি মনে করেন, এভাবে চলতে থাকলে রোগীরা চিকিৎসা না নিয়েই মারা যাবে।

আরেকটি ঘটনা রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। শাখাওয়াত নামে এক যুবক নারায়ণগঞ্জ থেকে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার বাবাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে রেফার করেন। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে এসে বেকায়দায় পড়তে হয় তাকে।

শাখাওয়াত দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে এখানে আসতে ভাড়া দিয়েছি দেড় হাজার টাকা। আর এখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়ার জন্য ভাড়া চাওয়া হচ্ছে দেড় হাজার টাকা। বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্স আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা বাইরের অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দিচ্ছে না। তাদের ইচ্ছেমতো চাওয়া ভাড়াতেই যেতে হবে। অতিরিক্ত ভাড়া বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাম্বুলেন্সের মালিক আর চালকরা বলেন, অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় আমরা তো কমই নিয়ে থাকি। মাত্র সাত কিলোমিটারে ভাড়া কীভাবে দেড় হাজার টাকা হয়? জানতে চাইলে তারা বলেন, দেখুন গিয়ে বার্ডেমের (বারডেম জেনারেল হাসপাতাল) সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্স হলে তিন হাজার টাকার নিচে যেতে পারতেন না। আমরা তো মাত্র দেড় হাজার টাকা চেয়েছি।

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল, সরকারি শিশু হাসপাতালসহ প্রায় সবকটি হাসপাতালে গড়ে উঠেছে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার শক্তিশালী সিন্ডিকেট। শুধু রাজধানীই নয়, গোটা দেশেই রোগী পরিবহনে এভাবে গড়ে উঠেছে শত শত শক্তিশালী অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। জরুরি প্রয়োজনেও কেউ হাসপাতালের বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্স এনে সেবা নিতে পারছেন না। বাইরের অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে রোগী।

হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়া কিংবা আশঙ্কাজনক রোগীদের নিয়ে নিত্যদিন চলে টানাটানি। কখনও এমন বহুমুখী টানা হেঁচড়ায় রোগী প্রাণ হারান। কখনও শঙ্কিত হয়ে পড়েন রোগীর স্বজনরা। যারা রাজধানীতে থাকেন, তারা কোনোভাবে সমস্যা সমাধান করে ফেললেও গ্রাম থেকে আসা রোগীর স্বজনদের নাজেহাল হতে হয়।

অন্যদিকে আবার সরকারি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের দেখাই মেলে না। দুয়েকটির দেখা মিললেও চালকের সন্ধান মেলে না। এমন সুযোগে রোগীদের মরণাপন্ন সংকট মুহূর্তে বেসরকারি পর্যায়ে সিন্ডিকেটভিত্তিক অ্যাম্বুলেন্সগুলো ইচ্ছেমত ভাড়া আদায় করেন। রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে ফেলেন। অথচ এসব অ্যাম্বুলেন্সের বেশিরভাগেরই নেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদী। দুয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও চালকরা নানা অজুহাতে তা ব্যবহার করে না। লাগামহীন ভাড়া নিলেও সেবার বিষয়ে কথা বললেই নাজেহাল হতে হয় রোগীর স্বজনদের।

জরুরি পরিবহন হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সে বেশি লাভ হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছেন এ ব্যবসায়। এর ওপর অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে কম শুল্ক, স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভ ও তুলনামূলক কম ঝামেলা হওয়ায় বিগত কয়েক বছর থেকে এই ব্যবসার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। বাংলাদেশ রোড ট্র্যান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রমতে, ২০১০ সাল পর্যন্ত সারাদেশে রেজিস্ট্রেশন করা অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ছিল ২৭৯৩টি। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮৭১টিতে। এর মধ্যে ২০১১ সালে ২১৯টি, ২০১২ সালে ১৮১টি, ২০১৩ সালে ২৪৩টি, ২০১৪ সালে ৩৩৮টি, ২০১৫ সালে ৪৮০টি, ২০১৬ সালে ৩৭৮টি, ২০১৭ সালে ৪৯৫টি, ২০১৮ সালে ৫৬৪টি ও ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত বেড়েছে ১৮০টি। সব মিলিয়ে সারাদেশে মোট ৫৮৭১টি অ্যাম্বুলেন্সের রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে বিআরটিএ। তবে বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন