ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আকস্মিক লোডশেডিংয়ে চরম ভোগান্তি

bazar
  • ইফতার-সাহরিতে অতিষ্ঠ রোজাদার
  • বৈদ্যুতিক সেচ পাম্প বন্ধ, বোরো চাষে শঙ্কা
  • পোল্ট্রি খামারে উৎপাদন কমেছে
  • বন্ধ থাকছে বিদ্যুৎচালিত তাঁত
  • পড়া লেখায় ব্যাঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা

চৈত্রের প্রখর রোদ, তীব্র তাপদাহ। রাতে ভ্যাপসা গরম। সারাদিন রোজার পর ক্লান্ত শরীর। এমন সময় রাতে নিয়মিত লোডশেডিং। সব মিলিয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ। গত কয়েক বছর ভালোই চলছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ। লোডশেডিংয়ের থাবা পড়েনি জনজীবনে। হঠাৎ গত পনেরো দিনের লোডশেডিংয়ে নাকাল জনজীবন। রমজানের শুরু থেকে লোডশেডিংয়ে মাত্রা আরও বেড়েছে। অতিষ্ঠ হয়ে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও করার ঘটনাও ঘটেছে। টাঙ্গাইলের সবকটি উপজেলার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পুরো টাঙ্গাইলে বিদ্যুৎ সরবরাহের চিত্র অভিন্ন। এমন ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে প্রভাবে অতিষ্ঠ জনজীবন। প্রভাব পড়েছে কৃষি, শিল্প ও শিক্ষার ওপর।

বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং এখন প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন-রাত যেকোন সময় এ বিদ্যুৎ আসছে, আবার যাচ্ছে। এ কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের। বিদ্যুৎসেবা প্রদানের জন্য অভিযোগ নাম্বারে ফোন করা হলেও কোনো সাড়া মিলছে না অফিস কর্তৃপক্ষের। এমন অভিযোগ গ্রাহকদের। এদিকে রমজান মাসে ইফতার, তারাবি নামাজ ও সাহরির সময় লোডশেডিং না দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। বরং ওই সময়গুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত নির্ধারিত এ সময়গুলোই লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ছে। বিদ্যুৎ অফিসের দাবি বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে সমন্বয় করে বিদ্যুৎ সরবরহ করতে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। রাতে বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকায় তারাবির নামাজ পড়তে মুসুল্লিদের ব্যাঘাত ঘটছে। বিপাকে পড়তে হচ্ছে পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধবয়সিদের। মুসল্লিরা জানান, বিদ্যুৎ না থাকায় মসজিদের মাইকে আজান দেয়া ও নামাজ আদায়ের সময় প্রচণ্ড গরমে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। রোজার শুরু থেকে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে।

এদিকে বোরো আবাদের গুরুত্বপূর্ণ সময় পার হচ্ছে। প্রতিটি ধানের চারায় শীষ বের হচ্ছে। এমন সময় লোডশেডিংয়ের চাপে বৈদ্যুতিক সেচ পাম্প চালাতে ব্যাঘাত ঘটছে। এতে নিয়মিত পানি দিতে না পারায় বোরো জমিগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। গোড়ায় পানি না থাকায় শীষ বের হচ্ছে না। এভাবে পানির অভাব হলে বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আশংকা করছে সংশ্লিষ্টরা। লোডশেডিংয়ের কারণে সেচ-সংকট এখন চরম আকার ধারন করেছে। আরিফুর রহমানের মতো সেচপাম্প মালিকেরা জানান, ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষি জমিতে সেচ দিতে পারছি না। বিদ্যুৎ কতবার আসে আর যায় তার হিসেব নেই। এতে বোরো চাষে সেচ সংকট দেখা দিয়েছে। এক দিকে বৃষ্টি নেই, অন্যদিকে থাকে না বিদ্যুৎ। আমরা বিপদে পড়েছি আমন ধান নিয়ে।

বোরো আবাদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পোল্ট্রিশিল্প। বিশেষ করে ব্রয়লার খামারগুলো অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। একঘণ্টা লোডশেডিং হলেই খামারে মুরগী স্ট্রোকে মারা যেতে থাকে। অতি গরমে মুরগীর মৃত্যুর পাশাপাশি খাবার খাওয়া কমে যায়। এতে মুরগীর মাংস বৃদ্ধির গতিও কমে আসে। গরমে মুরগীর ঠান্ডাজনিত রোগ বাড়তে থাকে। এতে বৈদ্যুতিক লোডশেডিংয়ে সঙ্গে খামারিদের লাভ-লোকসানও নির্ভর করে। মুরগীর খাবারের ডিলার ও ঔষধ বিক্রেতা মোহাম্মদ রুবেল হাসান বলেন, লোডশেডিংয়ে কারণে পুরো পোল্ট্রিশিল্প ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ শিল্পের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে ব্রয়লার মুরগী। অতি গরমে মুরগীর স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকে মুরগীর মৃত্যু শুরু হলে নিমিশেই খামার খালি হয়ে যেতে পারে।

এদিকে লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়েছে তাঁতশিল্পের ওপর। করোনার কাটিয়ে ঈদ ও পহেলা বৈশাখের চাহিদা মেটাতে শাড়ি উৎপাদন বাড়ছিল। এমন সময় লোডশেডিংয়ের প্রভাবে রাতে শাড়ি উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুৎ চালিত তাঁতেরও উৎপাদনও বন্ধ থাকে। দিনের বেলাতেও লোডশেডিং হওয়ায় তীব্র গরমে শাড়ি তৈরিতে ব্যাঘাত হচ্ছে শাড়ি শ্রমিকদের। শাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত্বাধিকারী বাদল রাজবংশী ও শাড়ি বিক্রেতা পলাশ বসাক জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে শাড়ি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এতে শাড়ি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা পূরণে বিঘ্ন ঘটবে। অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানায় প্রতিদিন অসংখ্য শ্রমিকের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে ক্রমেই লোকসানের মুখে পড়ছে তাঁতশিল্প।

সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। করোনার প্রভাবে দুইবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর পড়ালেখার পরিবেশ কেবল মাত্র স্বাভাবিক হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে লোডশেডিংয়ের প্রভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ব্যাঘাত হচ্ছে। ভ্যাপসা গরমে শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে নিয়মিত হতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা জানান, করোনার কারণে অনেকদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার পর আবার খুলেছে। ঠিকমত বিদ্যুৎ না থাকায় পড়াশোনা করতে পারছিনা। এতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

টাঙ্গাইল পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির জিএমের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। পরে পল্লী বিদ্যুতের পাথরাইল শাখা অফিসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুদিন আগে তাদের নিয়ে টাঙ্গাইল পল্লীবিদ্যুৎ বিভাগে মিটিং হয়েছে। সেখানে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। তবে উৎপাদন বাড়াতে কাজ চলছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

টাঙ্গাইল পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহম্মেদ ঢাকায় থাকায় কথা হয় সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, বর্তমানে বিদ্যুতের লোডশেডিং একটি জাতীয় সমস্যা। গ্যাসের ক্রাইসেসের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের ঘাটতি হচ্ছে। টাঙ্গাইলে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ২৫০ মেগাওয়াট। রবিবার বেলা ১১টার তথ্য অনুযায়ী বিদ্যুৎ ছিল ১৬০ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের ঘাটতি হয় ৯০ মেগাওয়াট। এ ঘাটতি পূরণ করতে বিদ্যুতের লোডশেডিং দিতে হয়। তবে খুব শিগগিরই বিদ্যুতের এ সমস্যা সমাধান হবে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ কাজ করছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন