রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছোট হর্নে বড় দূষণ

ছোট হর্নে বড় দূষণ

দেশের অন্যান্য এলাকার মতো টাঙ্গাইল শহরেও প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণের মাত্রা বাড়ছে। অসহনীয় মাত্রার শব্দ দূষণের ফলে নানামুখী সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে। শহরবাসীর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে বধিরতাজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, সচেতনার অভাবে যত্রতত্র ইলেকট্রিক ও অনুমোদনহীন হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহারের কারণে শব্দ দূষণ বেশি হচ্ছে। শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা গড়ে ৬০ ডেসিবেল হলেও টাঙ্গাইল শহরের কয়েকটি স্থানে ১০৩ ডেসিবল পর্যন্ত দেখা গেছে।

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি শহরের গুরত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি স্থানের শব্দের মানমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, শহরের নিরালা মোড় সর্বনিম্ন ৬২ ডেসিবল, সর্বোচ্চ ৯৮ ডেসিবল, বেবিস্ট্যান্ডে সর্বনিম্ন ৭৪ ডেসিবল, সর্বোচ্চ ১০৩ ডেসিবল, নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সর্বনিম্ন ৭৫ ডেসিবল, সর্বোচ্চ ১০৩ ডেসিবল, বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে সর্বনিম্ন ৭৫ ডেসিবল, সর্বোচ্চ ১০৩ ডেসিবল। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হওয়ায় মানবদেহের জন্য এসব শব্দ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

শব্দের মাত্রা পরীক্ষা করা এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ এলাকাতে বড় গাড়ি চেয়ে ছোট রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটো সিএনজি চলছে। এসব ছোট ছোট যানবাহনের চাপে অধিকাংশ সময় শহরে যানজট লেগে থাকে। অটোরিকশাগুলো তিন-চার লেনে চলার চেষ্টা করে। তখন অনবরত হর্ন চলতে থাকে। এসব ছোট ছোট হর্নের মাধ্যমে বড় ধরনের দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, টাঙ্গাইল শহরে পৌরসভার নিবন্ধিত অটোরিকশা (ইজিবাইক) চার হাজার তিনশ। বাস্তবে চলাচল করছে ১০ হাজারেও বেশি। ফলে শহরের ব্যস্ততম সড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত যানজট হচ্ছে। যানজট থেকে অতিমাত্রায় হর্ন ব্যবহারে শব্দ দূষণ ঘটছে।

আরও পড়ুনঃ  তরুণ সাংবাদিক ফাহিরের মৃত্যু

বিন্দুবাসিনী সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছে, তাদের স্কুলের সামনে জেলা সদর সড়ক, পিছনে মেইন সড়ক ও পার্ক বাজার। এসব এলাকার যানবাহনের হর্নের কারণে ক্লাস করা কষ্টসাধ্য। মাঝে মাঝে পৌর উদ্যানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ক্লাস করতেও কষ্ট হয়। শব্দ দূষণ রোধে প্রশাসনসহ কর্তৃপক্ষের নজরদারি চায় তারা।

শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ডবাসীদের অনেকে জানান, রাত দিন প্রায় ২৪ ঘণ্টাই বাস, ট্রাক, সিএনজিসহ বিভিন্ন যানবাহনের হর্নের শব্দে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে শহর। বিশেষ করে পাশেই সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের রোগিদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়।

ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী নাজিয়ান নুসরাত অর্থি ও হৃদয় চন্দ্র বলেন, শহরের গুরত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি স্থানে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় বিভিন্ন যানবাহনের হর্নের ওপর গবেষণা করেছি। শব্দ দূষণ নিয়ে কাজ করার সময় সাউন্ড প্যারামিটারে যে ফলাফল পেয়েছি তা মানবদেহের জন্য খুব ক্ষতিকর। শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড ও নিরালার মোড়ে শব্দ দূষণ বেশি হয়।

একই বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, বিভিন্ন জায়গায় শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা আছে, যা স্বাস্থ্যসম্মত। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকাসহ এর আশেপাশে শব্দদূষণের মাত্রা অতিক্রম করেছে। এতে আবাসিক এলাকার মানুষের ক্ষতি ও শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে। শব্দদূষণের কারণের আমাদের মনজাগতিক পরিবর্তন হয়। মেজাজ খিটখিটে ও বদমেজাজি হয়। ফলে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। শব্দদূষণ প্রতিনিয়ত হলে আমরা শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।

ড. এএসএম সাইফুল্লাহ আরও বলেন, রিকশা, অটো, সিএনজি, বাস ও ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে ইলেকট্রিক বা হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। একজন মানুষ যখন রাস্তায় চলাচল করে এইসব যানবাহনের হর্নে কান পাতা দায় হয়ে যায়। রাস্তায় যেসব ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করে তাদের জন্যও ক্ষতিকর।

আরও পড়ুনঃ  বাণিজ্য সর্ম্পক বাড়াতে আগ্রহী ভারতের ৭টি অঙ্গরাজ্য

টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের নাক, কান গলা কনসালটেন্ড ডা. এস সি পণ্ডিত বলেন, বর্তমানে আবাসিক আর শিল্পকারখানা এলাকা একাকার হয়ে গেছে। অতিরিক্ত শব্দ দূষণের ফলে কানে কম শুনতেছি। বার্ধক্যজনিত কারণে এমনিতেই মানুষ কানে কম শোনে। তবে আমরা শব্দ দূষণের কারণে জীবনের অর্ধেক সময় কানে কম শুনছি। হাসপাতালে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ জন রোগী দেখলে সেখানে প্রায় অর্ধেক কানে কম শোনা রোগী আসে।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি মালা ২০০৬ অনুযায়ী শব্দের মানদণ্ড বেঁধে দেয়া হয়েছে। তবে টাঙ্গাইলসহ সারাদেশে মানদণ্ডের অনেক বেশি ব্যবহার হচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনার অভাবের কারণে যত্রতত্র হর্ন ব্যবহার করছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা ফেরাতে অনুষ্ঠান করছি। শব্দ একটি নীরবঘাতক। এটি মানুষকে বোঝানো হচ্ছে। যত্রতত্র হর্ন ব্যবহারেও সতর্ক করা হচ্ছে। কেউ না মানলে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে শব্দ দূষণে ঢাকার নাম বিশ্বের শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে। তবে এই তথ্যপ্রকাশ হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মাঝে কতোটা সচেতনতা ফিরে আসবে এটাই দেখার বিষয়। কেননা শব্দ দূষণে সাধারণ মানুষের অসচেতনতাকেই দায়ি করছেন পরিবেশবিদরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রাসহ নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন