নগরায়ন আর শিল্পায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আর উদাসীনতায় প্রায়ই দূষণে বিশ্বে সবার ওপরে ওঠে আসছে ঢাকার নাম। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে দূষণ কয়েক গুণ ছাড়িয়ে যাওয়ায় বাসযোগ্যতায় পিছনের সারিতে মেগা শহরটি।
বায়ু, পানি, শব্দ, প্লাস্টিক দূষণ ও সর্বোপরি পরিবেশ দূষণে শুধু স্বাস্থ্যগত-অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয় বদলে যাচ্ছে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও আচরণ। সামাজিক আচার আচরণে ক্ষুব্ধ মনোভাব আর অসহিষ্ণুতা দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে ধুলা ও বায়ু দূষণের প্রভাবে সর্দিকাশি আমাশয় ও নানা ধরনের রোগব্যধি বাড়ছে। সম্প্রতি রাজধানীসহ আশেপাশের জেলায় ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার পেছনের কারণ হিসেবে দূষিত পানির বিষয় উঠে এসেছে।
বিশ্বের অন্যতম দূষিত বায়ুর দেশ ও কার্বন নিঃসরণকারী চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বায়ুর মানে উন্নতি ঘটছে। তবে ঢাকার বায়ুর মানে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল ও যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসার পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য উঠে আসছে। এ বিষয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, সব ধরনের দূষণে মানুষের মনের ওপরে আগে প্রভাব পড়ে। শারীরিক প্রভাবের আগেই মানসিক প্রভাবটা দেখা দেয়। দূষণ দেখলেও মানুষের মন খারাপ হয়।
এর মধ্যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন গবেষক দাবি করছেন, বায়ুদূষণের কারণে অপরাধ বাড়ে, মানুষ অনৈতিক আচরণ বেশি করে। গবেষণায় আরো দেখানো হয়েছে, পরিবেশ বিপর্যয় বা বায়ুদূষণ মানুষের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। উদ্বিগ্ন মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তাবোধ কাজ করে। অনেকের অনৈতিক আচরণের গতি পরিবর্তন হয়।
বাংলাদেশে দূষণের প্রভাবে অপরাধের হার বাড়ছে কিনা তা নিয়ে কোনো গবেষণা না থাকলেও দৈনন্দিন জীবনে মানুষের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত রাস্তায় বাসে বা গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে মানুষের মধ্যে তর্কবিতর্ক লেগেই থাকছে। ছোট বিষয় নিয়ে হাতাহাতি থেকে হত্যা পর্যন্ত ঘটে যাচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনে রাস্তা গরম থাকছে নিয়মিত বিরতিতে। এতেও অনেকে নগর জীবনের দুর্বিষহ দূষণ পরিস্থিতির প্রভাব দেখছেন। বাসা-বাড়িতে সহিংসতাও বেড়েছে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হারে।
তাড়াছা অল্পতেই মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। মেনে নেয়ার প্রবণতা কমে যাওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে মহামারির মতো। মানসিক বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ঠুনকো কারণে সংসার ভেঙে গিয়ে সামাজিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে। যানজটের কারণেও মানুষ মেজাজ হারাচ্ছে। কর্মশক্তিও কমে আসছে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলছেন, মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। একটা গাড়ি এক মিনিট অপেক্ষা না করে সামনে গিয়ে যানজট সৃষ্টি করছে। মানসিক চাপ নিয়ে মানুষ বাসায় ফিরছে। ফলে অশান্ত মানসিক অবস্থায় ঘরের মানুষের সঙ্গেও সুন্দর ব্যবহার করতে পারে না। যা থেকে পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ নয়েজ কন্ট্রোল বলছে, পথের শব্দের কারণে একজনের হাইপারটেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হয়। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর জন্মগত ত্রুটি তৈরি হতে পারে। শব্দ দূষণের কারণে ব্লাড প্রেশার, শ্বাসের সমস্যা এমনকি হজমের সমস্যা তৈরি হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
খাদ্য দূষণের কারণে অন্ত্রের নানা রোগ, লিভার, কিডনি বা পাকস্থলী কার্যকারিতা হারাচ্ছে। গ্যাস্ট্রিক আলসারসহ নানা সমস্যার তৈরি হচ্ছে। কখনো কখনো এসব কারণে ক্যান্সারের মতো রোগও তৈরি হচ্ছে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে এ ধরণের দূষিত খাবার খেলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বা বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে বিষণ্নতার হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরে বিষণ্নতার হার ৮ দশমিক ২ আর গ্রামে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) আরেকটি গবেষণায় রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে বলে জানানো হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, শব্দ দূষণের সামাজিক প্রভাব প্রচণ্ড। স্কুল, কলেজ বা হাসপাতালে পাশে যে শব্দ হয়, সেখানে মানুষ মনোযোগ দিতে পারে না। তার মনোযোগে ঘাটতি ঘটায় এই শব্দ। এই শব্দের কারণে কাজের পারফরম্যান্স বা পড়াশোনায় মনোযোগ অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়া ক্ষুধামন্দা, হৃদরোগ হচ্ছে শব্দদূষণের কারণে। শব্দ মানুষের ব্রেনে সরাসরি আঘাত করে। ফলে, মানুষের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। সব সময় সে অস্থিরতায় ভুগছে। সোশ্যাল ভায়োলেন্সেরও একটা কারণ এই শব্দদূষণ বলে জানান চিকিৎসকরা।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পারসপেক্টিডের গত ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে ‘বায়ুদূষণের সঙ্গে বিষণ্নতা, রাগ, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজ ও আত্মহত্যার সম্পর্ক’ শীর্ষক এক নিবন্ধ। এতে বিশ্বের ১৬টি দেশের ১৯৭৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বায়ুদূষণ–সংক্রান্ত তথ্য–উপাত্তের সঙ্গে ১৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সী মানুষের বিষণ্নতার সম্পর্ক তুলনা করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে গবেষকেরা জানান, দূষিত বায়ুতে শ্বাস–প্রশ্বাস নেওয়া মানুষেরা অন্যদের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি বিষণ্নতায় ভোগে। আর তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
সর্বোপরি দূষণের প্রভাব নিয়ে পরিবেশবিদ ড. কামরুজ্জমান বলেন, শব্দ দূষণের ফলে মানুষ বাসার বাইরে যেতে চান না। মানসিক চাপে অনেকটা বিকারগ্রস্ত থাকেন অনেকটা। ফলে দূষিত নগর হলো মানসিক চাপ যুক্ত নগর।
আনন্দবাজার/শহক