আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/ আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি…বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে/ মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ
…
… রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র এ কবিতা পড়লে একটা দৃশ্যকল্প চোখের সামনে ফুটে ওঠে। একাত্তরে মানবসভ্যতার ইতিহাসে ভয়াবহতম গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। কবি তার কল্পনায় আজকের বাতাসেও সেই ভয়াবহ অপরাধের ঘ্রাণ পান। অর্থাৎ যেখানে অপরাধ কিংবা হিংস্রতা সংঘটিত হয় সেখানকার বাতাসেও তার প্রভাব থাকে। সেই বাতাস অপরাধের স্মৃতি অথবা প্রমাণ বহন করে।
তবে এমন ঘটনার ঠিক বিপরীত সত্য জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, বাতাস দূষিত হলে সেই বাতাসে ডুবে থাকা মানুষের মনও অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভালো ঘ্রাণ বা সুবাস চারপাশের পরিবেশকে যেভাবে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়, একইভাবে ভালো কাজেও উদ্বুদ্ধ বা তাড়িতও করে। বিপরীত দিকে খারাপ বা দূষিত বাতাস পরিবেশকে সুনির্মল করে তুলতে ব্যর্থ হয়। যা মানুষকে খারাপ কাজ বা অপরাধে প্ররোচিত করে থাকে। অর্থাৎ সুবাসিত, নির্মল বাতাস মনকে যেমন উৎফুল্ল করে, তেমনি দূষিত বাতাস মনকে ততটাই বিষিয়ে দেয়, অপরাধী করে তোলে।
বায়ুদূষণে গেল কয়েক বছর ধরে দফায় দফায় বিশ্বের শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে দূষিত বায়ুর রাজধানী হিসেবে ঢাকা এখন বিশ্বসেরা। অথচ বছর চারেক আগে ২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণজনিত নানা অসুখ-বিসুখের কারণে প্রতিবছর ২৮ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আর বিশ্বে ঠিক একই করণে গড় মৃত্যু মাত্র ১৬ শতাংশ। সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর চার বছর পার হয়েছে। সেই সময়ের চেয়ে দেশের বা ঢাকার বাতাস এখন আরো বেশি দূষিত। বলা যায়, বায়ুদূষণ এখন জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় উঠে আসার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যা থেকে প্রশ্ন উঠছি, ঢাকার বিশ্বসেরা দূষিত বায়ু শুধুই কি প্রাণই কেড়ে নেয়ার হারই বাড়িয়ে দিচ্ছে, নাকি অন্যকোনো প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব ফেলছে পরিবেশে কিংবা মানুষের সমাজে?
প্রাপ্ত তথ্যমতে, এখন অবধি বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে তা সীমাবদ্ধ থেকেছে শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ রোগসৃষ্টির মধ্যেই। ভয়াবহভাবে দূষিত হয়ে ওঠা বাতাস জনগণ বা জনসমাজের মনস্তত্ত্বের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে কোনো গবেষণাই হয়নি এখন অবধি। তবে শেষ অবধি সেই কৌতুহল মিটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। তারা মানুষের মানসিক পরিস্থিতির ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে তার ফলাফল প্রকাশ করেছেন। গবেষণাটি যদিও বছর চারেক আগের, তারপরও আজকের প্রেক্ষাপটে তা গ্রহণযোগ্য হিসেবেই ধরা যায়। যৌথভাবে গবেষণাটি করেন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক জেকসন জি লুল, মেশিগান ইউনিভার্সিটির স্টেফেন এম রোজ স্কুল অব বিজনেসের জুলিয়া জে লি ও হার্ভার্ট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেসের এডাম ডি গেলিন্সকি।
যুক্তরাষ্ট্রের এসব গবেষক দেখিয়েছেন পরিবেশদূষণ তথা বায়ুদূষণে অপরাধ বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। তারা দেশটির ৯ হাজার ৩৬০টি শহরের বায়ুদূষণ আর ৯ বছরের সংঘটিত অপরাধের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এমন সিদ্ধান্তে আসেন। ‘পলিউটেড মোরালিটি: এয়ার পলিউশন প্রেডিক্টস ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি অ্যান্ড আন-ইথিক্যাল বিহেভিয়ার’ শিরোনামের সেই গবেষণাটি ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করে অ্যাসোসিয়েশন ফর সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স সাময়িকী।
গবেষণার জন্য যেসব শহর বেছে নেয়া হয়েছিল ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে সেসব শহরের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বায়ুর কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণা বা পদার্থের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। অন্যদিকে, অপরাধের তথ্য সংগ্রহ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) ইউনিফর্ম ক্রাইম রিপোর্টিং প্রোগ্রাম থেকে।
বায়ুদূষণের বিপরীতে অপরাধ পর্যালোচনার জন্য সাত ধরনের অপরাধকে বেছে নেয়া হয়। তার মধ্যে ছিল খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, গুরুতর আঘাত, সিঁদেল চুরি, সাধারণ চুরি ও মোটরযান চুরি। গবেষণায় দেখা যায়, স্বাভাবিক বাতাসে যেখানে ১ দশমিক ৬২ ভাগ হত্যা সংঘটিত হয়, দূষিত বাতাসে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ১১ ভাগ। আবার ধর্ষণের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বায়ুতে যেখানে ৭ দশমিক ৮৯ ভাগ সেখানে দূষিত বায়ুতে ৩৮ দশমিক ৬০ ভাগ। ডাকাতির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বায়ুতে ৪৬ দশমিক ২১ ভাগ, সেখানে দূষিত বায়ুতে ৪৭৫ দশমিক ৯১ ভাগ। চুরির ক্ষেত্রে ১৮৭ দশমিক ৮৫ ভাগ থেকে ৯৪৮ দশমিক ১৪ ভাগে, সিঁদেল চুরির ক্ষেত্রে ৬২৫ দশমিক ৭৯ ভাগ থেকে ৩০৩৬ দশমিক ৮৬ ভাগে, লাঞ্ছনার ক্ষেত্রে ৭৯ দশমিক ২৮ ভাগ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৬২৩ দশমিক ১৮ ভাগে। আর মোটর গাড়ি চুরির ক্ষেত্রেও ১১২ দশমিক ৩২ ভাগ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৮২৬ দশমিক ৬০ ভাগে।
গবেষণায় দেখা যায়, দূষিত বায়ুতে অপরাধ প্রবণতা বেশি বেড়ে যায় আমেরিকানদের মধ্যে। আর তাদের চেয়ে কম প্রবণতা দেখা যায় এশিয়ার দেশগুলোতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধের হার যেখানে শূন্য দশমিক শূন্য ৮১ ভাগ, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সেখানে শূন্য দশমিক শূন্য ২৫ ভাগ। গবেষণায় আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে বিগত ২০১৪ সালে ১৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণের শিকার হয়েছে। আর ভারতে ২০১৫ সালে ১৪ লাখ মানুষ বায়ুদূষণে প্রাণ হারিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের করা গবেষণার বিষয়ে দৈনিক আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে মন্তব্য চাওয়া হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইএনটি অ্যান্ড হেড-নেক সার্জারি বিভাগের প্রধান ও অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ডা. মনি লাল আইচ লিটুর কাছে। তিনি গবেষণা ব্যাপারে বলেন, ভালো ঘ্রাণ যেমন ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি খারাপ বাতাস খারাপ কাজ করতে প্ররোচিত করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাতে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।
দূষিত বায়ু মানুষের মনস্তত্ত্বে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ডা. মনি লাল আইচ লিটু বলেন, আমরা পুরুষ বা নারীরা কাউকে যে খারাপ কথা বলি, তার কারণ আমাদের মস্তিষ্কের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ তখন থাকে না। যা হয়ে থাকে দূষিত বায়ুর প্রভাবে। এমনকি দূষিত বায়ুর কারণে মানুষ জোরে কথা বলে, সহজে মেজাজ খারাপ করে, অল্পতেই রেগে যায়, উগ্র আচরণ করে। এক পর্যায়ে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সহজভাবে বললে, খারাপ বাতাসে মন-মেজাজ বিগড়ে গিয়ে মানুষ মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়েন।
অন্যদিকে, আজকের সমাজ অনেকটা ডিজিটাল আসক্তিতে আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ড. লিটু বলেন, প্রত্যেকেই মোবাইলসহ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছেন। এই আসক্তির কারণে পারিবারিক ও সামাজিক হৃদ্যতা নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে, মোবাইলে ব্যস্ত থাকায় শিক্ষার্থীদের ৫০ ভাগের পড়ালেখা নষ্ট হচ্ছে। এর পেছনেও দূষিত বায়ু বা খারাপ পরিবেশের প্রভাব কাজ করছে। ডা. মনিলাল আইচের পরামর্শ হচ্ছে, পরিবেশ আইনের ধারাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে সূর্যের আলোতে কাজ করার পরামর্শ তার। কারণ, অপরাধ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্ধকার ভূমিকা রাখে। সেজন্যই পরিবেশবান্ধব হতে হবে। সূর্যের আলো, বাতাস ও গাছপালা সমৃদ্ধস্থানে বসবাস ও কাজ করতে হবে। কারণ গাছপালা দূষিত বাতাস গ্রহণ করে নির্মল বায়ু উপহার দেয়।
আনন্দবাজার/শহক