ঢাকা | শুক্রবার
৩রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সচল হচ্ছেনা অচল যন্ত্রপাতি

সচল হচ্ছেনা অচল যন্ত্রপাতি
  • রংপুর মেডিকেলে ব্যাহত চিকিৎসাসেবা
  • তিন বছর ধরে অচল সিটিস্ক্যান মেশিন
  • এনজিওগ্রাম, ইকো আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনও বিকল
  • নেফ্রোলজি বিভাগে ১২টি কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন নষ্ট

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নষ্ট যন্ত্রপাতি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। বিকল হয়ে পড়ে আছে এনজিওগ্রাম মেশিন। সিটিস্ক্যান মেশিনও অচল। ইকো আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন দুই বছর ধরে চলছে না। নেফ্রোলজি বিভাগে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস মেশিন ২৮টির মধ্যে ১২টি নষ্ট। দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থা চলতে থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। হাসপাতালে ভর্তি মুমূর্ষু রোগীদের পরীক্ষা করাতে বিভিন্ন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যেতে স্বজনদের যেমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, তেমনি তাদের খরচও বাড়ছে। এতে দরিদ্র অধ্যুষিত এ বিভাগের মানুষের মধ্যে হতাশা  দেখা দিয়েছে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোকে অর্থ আয়ের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এমনটা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন ভ’ক্তভোগীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি বিভাগের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। কিছুদিন আগেও কিডনি রোগীদের জন্য ২৮টি ডায়ালাইসিস মেশিন ছিল নেফ্রোলজি বিভাগে। নষ্ট হতে হতে যার ১২টি এখন অকেজো। ১৬টি ডায়ালাইসিস মেশিনে কিডনি রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমসীম খাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীরা ঠিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রংপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার দুই শতাধিক কিডনি রোগী এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তারা অগ্রীম টাকা জমা দিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তাদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত চারদিন ডায়ালাইসিস করার জন্য আসতে হয়। এছাড়া নতুন রোগী তো আছেই। অনেক সময় রোগীরা লাইন দিয়েও সিরিয়াল পাচ্ছেন না। ফলে কিডনি রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া পানি ফিল্টারিং করার মেশিন  বেশিরভাগ সময় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। পানির অভাবে সচল ডায়ালাইসিস মেশিনও অনেক সময় কাজ করে না। ডায়ালাইসিস করাতে আসা এক রোগীর স্বজন সাহাবুল হক বলেন, ‘আমরা ২৫ হাজার টাকার প্যাকেজ কিনেছি। যা দিয়ে মাসে চারবার করে ছয় মাস ডায়ালাইসিস করার কথা। কিন্তু সুই থেকে শুরু করে সব জিনিষই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। একজন রোগীর ডায়ালাইসিস করতে চার ঘন্টা প্রয়োজন, সেখানে দেড় থেকে দুই ঘণ্টার বেশি ডায়ালাইসিস করানো হয়না।’

হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, এনজিওগ্রাম মেশিনটি ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে বিকল হয়ে পড়ে আছে। ফলে হৃদযন্ত্রের সঠিক পরীক্ষা, স্থায়ী ও অস্থায়ী পেসমেকারসহ রিং স্থাপন বন্ধ রয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট রোগীদের ঢাকা অথবা অন্য কোথাও যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের প্রথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওই বিভাগের তিনটি ইকো মেশিনের সবগুলোই নষ্ট। রক্ত পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন থেকে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকায় রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষাও করতে হচ্ছে বাইরে থেকে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিটিস্ক্যান মেশিন নেই প্রায় তিন বছর ধরে। দীর্ঘদিনেও নতুন সিটিস্ক্যান মেশিন না আনায় ভোগান্তিতে পড়েছে চিকিৎসাপ্রত্যাশী রোগীরা। হাসপাতালের কেবিনে থাকা জটিল রোগে আক্রান্ত এক রোগীর স্বজনরা জানান, রোগ নির্ণয়ের জন্য হাসপাতালের চিকিৎসক সিটিস্ক্যান করার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালে সিটিস্ক্যান মেশিন নষ্ট থাকায় বিপত্তিতে পড়তে হয়। রোগীর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে পরীক্ষার জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি জটিল রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীকে চিকিৎসার প্রয়োজনে বাইরে সিটিস্ক্যান করাতে নিয়ে যেতে  ভোগান্তিতে পড়ছেন স্বজনরা। হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখানে সর্বশেষ সিটিস্ক্যান হয়েছে তিন বছর আগে। দুটি সিটিস্ক্যান মেশিনের মধ্যে একটিকে পুরোপুরি বিকল ঘোষণা করা হয় ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ। অন্য সিটিস্ক্যান মেশিন পুরোপুরি বিকল হয়ে পড়ে ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট। যা বেশ কয়েকবার  মেরামত করে চালানো হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার মেশিন নষ্ট হওয়ায় বর্তমানে সিটিস্ক্যান বন্ধ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, গুরুতর রোগীদের জটিল রোগ নির্ণয় করতে সিটিস্ক্যান করা খুবই জরুরি। মেশিনারিজ জিনিস যেকোনো মুহূর্তে নষ্ট হতেই পারে। তবে সিটিস্ক্যান মেশিনগুলো সম্পর্কে সবসময় তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করে আসছেন।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসার অন্যতম ভরসাস্থল ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সংস্কারের অভাবে বর্তমানে আইসিইউ’র অবস্থাও নাজুক। ব্যাপক রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এখানে বিনামূল্যে আইসিইউ সুবিধা না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি মুমূর্ষু রোগীর প্রতিদিনের টাকা জোগাড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন স্বজনরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ বেডের আইসিইউর ছয়টি বেডে রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চারটি বেডের অক্সিজেন ও গ্যাস আউটলেট নষ্ট রয়েছে। ২০১২ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া আইসিইউর মুমূর্ষু রোগীদের হার্টের পরীক্ষার জন্য রাখা ইকো আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন, পোর্টেবল এক্স-রে  মেশিন এবং রক্ত ও শরীরের অন্যান্য তরল পরীক্ষার বায়োকেমিক্যাল অ্যানালাইজার মেশিন দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। তার পরও মুমূর্ষু রোগীদের ভিরে আইসিইউতে বেড মিলছে না। এখানে বেড না পেয়ে বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করা এক মুমূর্ষু রোগীর স্বজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, তার রোগীর অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। বেড ভাড়া, অক্সিজেন, ওষুধ ও লাইফ সাপোর্ট নিয়ে তাদের ১৩ দিনের মধ্যে প্রতিদিন খরচ হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অথচ রংপুর মেডিকেলের আইসিইউতে রোগী ভর্তি থাকলে যে ওষুধটি হাসপাতালে  নেই শুধু সেটি বাইরে থেকে কিনে আনতে হতো।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, দীর্ঘদিন থেকে হাসপাতালের এনজিওগ্রাম মেশিন, সিটিস্ক্যান মেশিনসহ বেশকিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে। এর ফলে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যাচ্ছেন। এতে সুষ্ঠু চিকিৎসা ব্যাহতসহ রোগীর স্বজনরা অর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তিনি দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নষ্ট যন্ত্রপাতিগুলো মেরামতের দাবি জানান। 

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রংপুর  মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, কয়েকটি নষ্ট হলেও বর্তমানে কিডনি বিভাগের ১৬টি ডায়ালাইসিস মেশিন সার্বক্ষনিক চালু রয়েছে। ফলে ওই ওয়ার্ডে সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে। তবে সিটিস্ক্যান মেশিন সারানোর অবস্থায় নেই। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া গেলে নতুন সিটিস্ক্যান মেশিন আনার ব্যবস্থা করা হবে। নষ্ট যন্ত্রপাতি মেরাতের চাহিদাপত্র ঢাকায় পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, আইসিইউর অচল বেডগুলো সচল করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারেও চাহিদা দেওয়া হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন