ঢাকা | সোমবার
৪ঠা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পানিসংকটে মরুকরণে বরেন্দ্র

পানিসংকটে মরুকরণে বরেন্দ্র

রাজশাহী মহানগরীর জন্য ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে প্রতিদিন ৯৫ হাজার ঘনমিটার পানি তুলছে রাজশাহী ওয়াসা। এর পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকাধীন পাম্পগুলো থেকেও প্রতিদিন উঠছে হাজার হাজার ঘনমিটার পানি। একদিনে এতে বিপুল পরিমাণে পানি উঠছে মাটির নিচ থেকে অপর দিকে ভূ-উপরস্থ পানির উৎস যাচ্ছে কমে। পানির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ইতোমধ্যেই রাজশাহী এখন ভয়াবহ খরা প্রবণ এলাকায় পরিণত হচ্ছে। দেশের প্রায় ২২টি জেলা খরার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে খুবই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ছয় জেলা। এগুলো হল- রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রিস্ক অ্যাটলাস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের খরাপ্রবণ জেলাগুলোয় মোট জমি রয়েছে প্রায় ৫৪ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। খরাপ্রবণ এসব এলাকা মূলত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। এর মধ্যে খরাপ্রবণ জেলা ১৩টি, খরা ও বন্যাপ্রবণ জেলা ছয়টি, খরা ও আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে তিনটি জেলা। নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও এই ছয়টি জেলা খরার খুবই উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। নানান কারণেই উত্তরে অবস্থিত রাজশাহী মহানগরী পানির ভারসাম্য হারাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। পানির স্তর ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে। এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ জাতীয় গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় কম হওয়ার কারণে পানির স্তর বর্ষা মৌসুমে আর আগের জায়গায় উঠে আসছে না। এর মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানি যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে প্রতিদিন ৯৫ হাজার ঘনমিটার পানি তুলছে রাজশাহী ওয়াসা। ফলে ভয়াবহ খরাপ্রবণ এ এলাকার পানির সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশের জাতীয় বৃষ্টিপাতের গড় ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার। বরেন্দ্র অঞ্চলে ১ হাজার ২০০ মিলিমিটার বা কোনো কোনো এলাকায় তারও কম বৃষ্টিপাত হয়। পানির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এদিকে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে প্রতিদিন যে ৯৫ হাজার ঘনমিটার পানি তুলছে রাজশাহী ওয়াসা। তবে এই পানি মোটেও নিরাপদ নয়। অতিমাত্রার ধাতব পদার্থসহ এই পানিতে রয়েছে ডায়রিয়ার জীবাণু ফেকাল কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া। এর বিকল্প হিসেবে পদ্মার পানি শোধনের মাধ্যমে রাজশাহী নগরে সরবরাহ করার উদ্যোগটি চার বছরেও পায়নি আলোর খোঁজ।

রাজশাহী ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে নগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা ১১ লাখ ১৩ হাজার ২৯০ ঘনমিটার। এর বিপরীতে ওয়াসা ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে ১০৮টি গভীর নলকূপ দিয়ে দৈনিক তুলছে ৯৫ হাজার ঘনমিটার পানি। শুধু বর্ষা-পরবর্তী চার মাস (আগস্ট-নভেম্বর) পদ্মা থেকে দৈনিক ৬ থেকে ৯ মিলিয়ন লিটার পানি পাওয়া যায়। এ ছাড়া পুরো মৌসুমজুড়েই নির্ভর করতে হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানায়, ভূ-গর্ভস্থ পানি ছাড়া রাজশাহীতে এখনও বিকল্প কোনো পানির উৎস নেই। এ কারণে অতিমাত্রায় ধাতব পদার্থ পাওয়া গেলেও পানি তোলা হচ্ছে ওই ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকেই। ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ পরিবেশের জন্যও হুমকি দেখা দিয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান বলেন, প্রতিদিন মাত্রাতিরিক্ত পানি তোলার ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তবে কয়েক বছর বেশি বৃষ্টি হওয়ায় রিচার্জও হচ্ছে। নিরাপদ খাবার পানির চাহিদা মেটাতে হলে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার ছাড়া বিকল্প নেই। এ কারণেই ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারে জোর দেওয়া উচিত।

তবে এখানেও আছে সীমাবদ্ধতা। একসময় ৪ হাজারের বেশি পুকুর ছিল রাজশাহীতে। এখন আছে তা হাতেগোনা। ভরাট হয়েছে পুকুরগুলোও। বিগত বছরগুলোতে রাজশাহীতে আশঙ্কাজনক হারে জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। গত ৫৯ বছরে রাজশাহীর জলাশয়ের প্রায় ৯৭ দশমিক ১৬ শতাংশ দখল ও ভরাট হয়েছে। ৯৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজশাহী শহরে এখন জলাশয় আছে মাত্র ১২০টি। যার মধ্যে কেবল ২২টি পুকুর সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে অগ্নি নির্বাপনের সময় পানির উৎস নিয়েও বর্তমান সময়ে দেখা দিয়েছে সংকট।

হেরিটেজ রাজশাহীর এর হিসাব অনুযায়ী, রাজশাহী শহরে সবচেয়ে বেশি জলাশয় ছিল ১৯৬০ সালে। তখন সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৪ হাজার ২৩৮। ১৯৮১ সালের এক জরিপে জলাশয়ের সংখ্যা পাওয়া যায় ২ হাজার ৭১। ২০১৯ সালের জরিপে দেখা যায়, রাজশাহীতে ১২ কাঠা বা তার বেশি আয়তনের জলাশয় আছে ১২০টি।

রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মামুদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে চীনের সঙ্গে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনাগার নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সমঝোতা সই, সম্ভাব্যতা যাচাই ও বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছে। শুধু বাকি ঋণ চুক্তি। আগামী তিন মাসের মধ্যে ঋণ চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পরই কাজ শুরু হবে। এর মাধ্যমে চার বছরের মধ্যে নগরবাসীকে পদ্মার সুপেয় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন এই প্রকৌশলী।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন