বিশ্ব মানচিত্রে লালসবুজ রঙের পতাকার স্থান করে নেবার দিন আজ। বাংলাদেশ নামের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশটি পেতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিন। বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের শুরুর দিন। পরাধীনতার শেকল ভাঙার দিন। মহান স্বাধীনতা দিবস। আজ ২৬ মার্চ। গৌরবের ৫১ বছরে পা ফেলল মহান স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানের শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহিদ হয়েছে ৩০ লাখ বাঙালি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা আর পাশবিকতার শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারিয়েছেন দুই লাখ নারী।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে বাঙালি পিছপা হয়নি। নয় মাস যুদ্ধ চালিয়ে দখলদার পাক হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ নামের একটি দেশ। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশনা অনুযায়ী যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। পূর্বপাকিস্তান থেকে পাকিস্তানিদের হটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে বাঙালি জীবন উৎসর্গ করে। পাকিস্তান সেনারা বাঙালির ওপরে চালায় সশস্ত্র নির্যাতন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি। বিজয় অর্জনের পর বাঙালি স্বাধীন দেশ পেয়েছে ঠিকই তবে পাকিস্তানের দোসরদের কবল থেকে মুক্ত হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র চালিয়েছে নানা ষড়যন্ত্র। এসেছে নানা বিপর্যয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরাজিত শক্তির দোসররা সপরিবারে হত্যা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। তারা চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে থমকে দিতে। সাময়িক সময় তারা দেশকে পিছিয়ে দিতে পারলেও শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জাতিকে স্তব্ধ, স্তম্ভিত করা হয়েছিল। এরপর অপেক্ষা ছিল সেই নাবিকের। যে এসে আবার হাল ধরবেন। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশের হাল ধরলেন। সেই সর্বস্বান্ত বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। জননেত্রী শেখ হাসিনার পথ ধরে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে এ পথপরিক্রমায় যুক্ত হয়েছে গৌরবময় সাফল্যগাঁথা।
জাতির পিতার হাত ধরে যে দেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে ঠাঁই পেয়েছিল এখন তারই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার তালিকায়। স্বাধীনতার পর দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশ। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশ। গড় আয় ছিল ১০০ ডলার, যা এখন বেড়ে গিয়ে ২ হাজার ৫শ ৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি গত ১৩ বছরে অর্জিত হয়েছে ৬ থেকে ৮ শতাংশ হারে। অতি সম্প্রতি পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পূর্ণ বাস্তবায়নে সারাদেশ শতভাগ বিদ্যুতায়িত হয়েছে। আগামী বছর নিজস্ব অর্থায়নে চালু হচ্ছে রেলসহ পদ্মা সেতু। এছাড়াও মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী টানেলসহ ১০/১২টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এই ৫০ বছরে তিল তিল করে গড়ে তোলা বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল নক্ষত্র। উন্নয়নের এই বাস্তবতায় খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে স্বাধীনতার স্বপ্ন, প্রত্যাশা, অর্জন, স্বাধীনতার যে প্রয়োজন তার কতটুকু আজ আমরা পূর্ণ করতে পেরেছি। পাকিস্তানের দীর্ঘ সময়ের শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন, শ্রেণিভেদ, সমাজের উঁচু নিচু অবস্থান থেকে মুক্তির জন্য দেশ স্বাধীন হয়েছিল। আজ এই ৫০ বছর পেরিয়ে তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী দিতে পেরেছি, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন কতটা পূরণ হয়েছে তা বিশ্লেষণ করার দিন।
ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের সহাবস্থান কতটা নিশ্চিত করতে পেরেছি, হানাহানি, সন্ত্রাস, সহিংসতা কতটুকু রোধ করতে পেরেছি, জীবনমানের উন্নতি কতটা করতে পেরেছি সেটাও পর্যালোচনা করতে হবে। দেশের সব মানুষের সমান অধিকারের ব্যবস্থা কতটা নিশ্চিত হয়েছে, সম্পদের সুষম বণ্টন, প্রতিটি এলাকার সুষম উন্নয়ন কতটা সম্ভব হয়েছে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদার কতটা পূরণের ব্যবস্থা হয়েছে, সেই সঙ্গে দারিদ্র্য, অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানো কতটা সম্ভব হয়েছে তা নিয়েও ভাবতে হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন, তার কতটা এগিয়ে নিতে পেরেছি। ৫০ বছর পেরিয়েও বাংলাদেশ কেন এতটা পিছিয়ে। কী কারণে, কাদের কারণে স্বাধীনতার ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। কারা স্বাধীন সার্বভৌম এই বাংলাদেশে জাতির জনককে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের বগলদাবা করে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের অপচেষ্টা করেছিল। কারা পাকিস্তানের দোসর আল বদর আলশামস রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা বহনের সুযোগ করে দিয়েছে। আজ ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও কাদের ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলাদেশ এতটা পিছিয়ে গেল। কারা সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মা। সেই উপলব্ধির সময় এসেছে।
আজ যেভাবে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসুরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী চিন্তা চেতনায় বাংলাদেশ উজ্জীবিত হয়েছে, উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে- সেসব ব্যাহত করতে কারা আবার নতুন করে ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতে উঠেছে তা উপলদ্ধি করতে হবে। আজ উপলব্ধি করার সেই দিন। নতুন প্রজন্মের জানবার দিন, বুঝবার দিন। মহান স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ সমাপনের মাস এটি। আর সেই গৌরবে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। উৎসবের আমেজে সারাদেশ সেজেছে আজ। একাত্তরের ২৫ মার্চে যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জীবনে তা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। আজ এই ৫১ বছরে এসে সেই স্বপ্নের কতটুকু পূরণ হয়েছে, কতটুকুই বা অপূর্ণ থেকে গেছে সে পর্যালোচনা করতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন নতুন প্রজন্মের মধ্যে কতটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি সেটাও হিসাব করতে হবে।