ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভোজ্যতেল উৎপাদনের বিকল্প নেই

ভোজ্যতেল উৎপাদন

সরকারি গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে গত চার বছরে মাথাপিছু তেলের ব্যবহার বা ভোগের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫ কেজি করে। ভোজ্যতেলের এই চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ছে। আগে শুধু রান্নাবান্নাতেই ব্যবহার হতো, এখন এর বহুমুখী ব্যবহার বেড়েছে। ভোজ্যতেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা সয়াবিন তেলের। রান্নাবান্নায় এই তেল দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে যেহারে চাহিদা বাড়ছে, ঠিক একই হারে কমছে দেশীয় উৎপাদন। চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা বর্তমান সময়ে ২০ লাখ টনে পৌঁছেছে। তার মধ্যে শুধু রমজান মাসেই অতিরিক্ত দুই লাখ টন তেলের প্রয়োজন হয়। ব্যবহার করার এসব তেলের ৭০ ভাগই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন হিসাব বলছে, দেশে ভোজ্যতেল উৎপাদন হয় মাত্র সাড়ে তিন লাখ টনের মতো। বাকি প্রায় সাড়ে ১৬ বা ১৭ লাখ টন তেল বাইরের দেশগুলো থেকে আমদানি করতে হয়।

মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) ফরেন এগ্রিকালচারাল সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সয়াবিন তেল আমদানিকারক দেশ। এখানে সয়াবিন তেলের বড় অংশই আমদানি করা হয়। বিপুল পরিমাণ তেলের আমদানির পেছনে সরকারকে বিপুল অর্থ যোগাতে হয়। অথচ এক সময় ভোজ্যতেলের প্রায় শতভাগই উৎপাদন হতো দেশে। আমাদের সমৃদ্ধ কৃষিখাতে এখনও সম্ভাবনা রয়েছে ভোজ্যতেল উৎপাদনের। ভোজ্যতেলের এই আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে উৎপাদনমুখী হওয়া যে প্রয়োজন সে ব্যাপারে গত ১৪ মার্চ দৈনিক আনন্দবাজারে ‘ফিরতে হবে চাষাবাদে’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আবহমানকাল ধরেই বাংলার ঘরে ঘরে সরিষা, তিল, তিসি, গর্জন, বাজনা জাতীয় তেলের চাষ হতো। গেল শতকের আশির দশক থেকে বিদেশ থেকে সয়াবিন, সূর্যমুখী তেল আসতে শুরু হলো দেশে। সেসব তেল এতটাই প্রভাব বিস্তার করলো যে সরিষা আর পেরে উঠছে না। তিল, তিসিও বইয়ের পাতায় স্মৃতি হয়ে গেল। গ্রামের নিম্নআয়ের মানুষও এখন সয়াবিন তেলের পেছনে দৌড়ায়। আর সয়াবিনের দাপটেই এক সময় দেশীয় ভোজ্যতেলের পরাজয় মেনে নিতে হলো।

গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বিষয়টির দিকে নজর ফিরিয়ে ভোজ্যতেলের আমদানি কমিয়ে উৎপাদনের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভ্যেজ্যতেল আমদানি কমিয়ে উৎপাদনে যেতে হবে। এ জন্য সয়াবিন ও সূর্যমুখীর চাষ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধন শিল্প নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল। ওই সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে তখন পরিশোধিত ভোজ্যতেলের চাহিদা ছিল বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম ধরে ২০২১ সালে তেলের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ ৯১ হাজার টনে দাঁড়াবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বর্তমানে ২০২২ সাল চলছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছে মাথাপিছু চাহিদা হবে গড়ে ১৪ দশমিক ৬ কেজি।

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষণ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশের চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ তেলই আমদানি করতে হয়। এটির স্থায়ী সমাধানে আমরা কৃষি মন্ত্রণায়কে অনুরোধ করেছি চাষাবাদে গুরুত্ব দিতে। কিনে খাওয়ার কারণে অন্যদেশের প্রতি আমাদের নির্ভর করতে হয়। এটির স্থায়ী সমাধান না হলে আমরা বার বার বিপদে পড়বো।

ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপন্ন হয়েছে। সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৭তম। আমদানিতে তৃতীয়। ২০০৩ সালে ১১ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন হয়। টানা কয়েক বছর পণ্যটির উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০০৪ সালে সয়াবিন উৎপাদন ৬৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার টনে।

২০০৫ সালে ২১ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। ২০০৬ সালে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার টনে। আর ২০০৭ সালে দেশে সয়াবিন তেল উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ২৭ হাজার টনে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে দেশে ২৪ হাজার ও ২০ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন হয়েছে। ২০১০ সালে সয়াবিন তেলের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার টনে। ২০১৩ সালে আগের বছরের তুলনায় ৩৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের (বিবিএস) কৃষি বিভাগের পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ দৈনিক আনন্দবাজারকে জানান, ২০১৮-১৯ সালে দেশে প্রায় ১১ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টনের বেশি শসামি তিল, রেপ ও মোসতার্ড, লিনসেড, সয়াবিন, নারকেল, সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয়েছে। এটি ২০১৭-১৮ সালে ছিল ১১ লাখ ২১ হাজার ৬১৭ হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ২৫ হাজার ৮৯৩ টন, ২০১৬-১৭ সালে প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৫৫২ টন।

আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, ২০১৫-১৬ সালে ১১ লাখ ২৫ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে ৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৮ টন ও ২০১৪-১৫ সালে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমিতে ৯ লাখ এক হাজার ৪৭৭ টন শসামি তিল, রেপ ও মোসতার্ড, লিনসেড, সয়াবিন, নারকেল, সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয়েছে। এই বিভাগের উপ-পরিচালক আখতার হাসান খান বলেন, মসুর ডাল থেকে অন্য শস্য ও সবজিতেও তেলের উপস্থিতি আছে। এসব জায়গা থেকেও তেল বের করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

সংবাদটি শেয়ার করুন