রবিবার, ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বস্তির কার্ডে অস্বস্তি

স্বস্তির কার্ডে অস্বস্তি

বেড়েই চলেছে দ্রব্যমূল্যের দাম। তার ওপরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে লাগামহীন বাজার। অভিযোগ রয়েছে দাম বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে বড় সিন্ডিকেট। আসন্ন রমজান উপলক্ষ্যে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে দাম বাড়ার নতুন শঙ্কা। কম দামে পণ্য পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন নিম্নবিত্তরা। এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি জোরদার করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে পণ্য দেয়া শুরু করেছে সরকার। তবে এভাবে পণ্য বিক্রিতে নানা অব্যবস্থাপনারও অভিযোগ উঠেছে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ক্রেতাদের। অনেক এলাকায় স্বজনপ্রীতিসহ স্বচ্ছল পরিবারেও কার্ড বিতরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। কার্ড দেখিয়ে যারা পণ্য পেয়েছেন, তারা খুশি হলেও কার্ড না পেয়ে পণ্য কিনতে না পেরে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছেন বাকিরা।

কার্ড বঞ্চিতদের অভিযোগ আগের রমজানে টিসিবির পণ্যের কারণে খরচ সহনীয় ছিল। এখন আর সে সুযোগ নেই। এ রমজানে কার্ড ব্যবস্থার কারণে টিসিবির নিয়মিত উপকারভোগীরা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনার সুযোগ হতে বঞ্চিত হতে পারেন। রমজান তাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে অসহনীয়। যারা কার্ড পেয়েছেন তাদেরও রয়েছে নানা অভিযোগ। অনেক স্থানে বেলা দুটার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় টিসিবির পণ্য। এর ফলে সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক নারী-পুরুষকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। প্রচণ্ড রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যারা পণ্য কিনতে পেরেছেন তাদের অনেকেই গচ্ছা দিয়েছেন দিনের রোজগার।

আরও পড়ুনঃ  চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে র‌্যাবের ক্রাইম প্রিভেনশন ক্যাম্প উদ্বোধন

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা ফতুল্লার দাপা এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন ৫৫ বছর বয়সী দুলাল হোসেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের এ জনক পেশায় রাজমিস্ত্রি। সকাল সাড়ে সাতটায় লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য পেয়েছে বেলা পৌনে একটায়। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য হাতে পেয়ে কিছুটা স্বস্তির হাসি দেন তিনি। পরক্ষণেই বুঝতে পারেন ডিউটির সময় পার হয়ে গেছে তার। কম দামে পণ্য কিনে ৫০০ টাকার আয় হাতছাড়া হয়ে গেছে। কিছু টাকা বাঁচাতে লাইনে দাঁড়িয়ে গচ্চা গেল এক দিনের রোজগার।

আবার সকাল থেকেই ট্রাকের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষের। কোথাও কোথাও সময়মতো পৌঁছায়নি টিসিবির ট্রাক। যেখানে সময়মতো পৌঁছেছে সেখানের অনেকে কার্ডই পাননি। তাদের কেউ কেউ তবু পণ্যের আশায় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পণ্য দেওয়া হয়নি তাদের।

সিলেটে সকাল ১০টা থেকে নির্ধারিত স্থানে শুরু হয় টিসিবির পণ্য বিক্রি। সেখান থেকে পণ্য নিতে এসে বিক্রয়কর্মীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছেন সুবিধাভোগীরা। বিশেষ করে নারীদের অভিযোগ বেশি। তারা বলছেন, বিক্রয়কর্মী ও স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবী লাইন ভেঙে পছন্দের লোকজনকে আগে পণ্য দিচ্ছে। আমরা নারীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বিক্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত পণ্যও রয়েছে টিসিবির গুদামে। কার্ডধারী ছাড়া টিসিবির পণ্য কাউকে দেয়া হবে না। বিতরণে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

মৌলভীবাজারের গোজারাই গ্রামের বৃদ্ধ আব্দুস ছালাম বলেন, ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে কোনোরকম দিন কাটাচ্ছি। অস্বচ্ছল হওয়ার পরেও কোনো কার্ড পাইনি। গরিবদের তেল, ডাল দেওয়া হচ্ছে শুনে ছুটে এসেছি। কিন্তু কার্ড না থাকায় পণ্য নিতে পারছি না। আরেক বৃদ্ধ আনোয়ারা হোসেন বলেন, চোখের সামনে ইউপি সদস্যদের ধনী স্বজনেরা কার্ড দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা গরিবরা পাই না।

আরও পড়ুনঃ  ইজতেমা মাঠ হবে কোয়ারেন্টাইন, দায়িত্বে সেনাবাহিনী

ফ্যামিলি কার্ড বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে মৌলভীবাজার জেলা শহরেও। অভিযোগ রয়েছে ধনী ব্যক্তিরাও পেয়েছেন টিসিবির কার্ড। আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরাও টিসিবির পণ্য নিতে দাঁড়িয়েছেন লাইনে। মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজ ও স্ত্রীর নামে কার্ড নিয়ে আসতেও দেখা গেছে একজনকে। কার্ড দেয়া হয়েছে ইংল্যান্ড প্রবাসী ও শিক্ষার্থীর নামে। শুধু তাই নয় এক পরিবারের দুইজনকেও কার্ড দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তাৎক্ষণিক বাতিল করা হয় কার্ড।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এর আগে কোনো সময়ই এক কোটি পরিবারকে পণ্য দেয়া হয়নি। এবারই প্রথম এই বড় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং পণ্য দেয়া হচ্ছে। অন্যান্য বারের চেয়ে এবার তার তিনগুণ পণ্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাহায্যে তালিকা করেছি যেন প্রকৃত লোকেরাই সুবিধা পায়। এখানে কার্ডের মাধ্যমে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। এতে একজনেরটা আরেকজনের কাছে চলে যাওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মন্সী বলেন, জনসংখ্যা ও দারিদ্র্যের সূচক বিবেচনায় নিয়ে তালিকা তৈরি করে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় এ তালিকা তৈরি করা হয়। যার মাধ্যমে রমজান উপলক্ষ্যে পণ্য দেয়া হচ্ছে। এসব পণ্য নিয়ে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্য মজুত করতে পারবে না। যদি কোনো ধরনের কারসাজির অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে হবে।

ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে একটি পরিবার প্রথম পর্যায়ে কিনতে পারবেন ২ কেজি চিনি, ২ কেজি ডাল ও ২ লিটার তেল। প্রতি লিটার তেলের মূল্য ১১০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা ও মসুর ডাল ৬৫ টাকা। অর্থাৎ একজন ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ৪৬০ টাকায় ২ লিটার তেল, ২ কেজি চিনি ও ২ কেজি মসুরের ডাল নিতে পারবেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই প্যাকেজের সঙ্গে ২ কেজি ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজ যুক্ত করে বিক্রি করা হবে।

আরও পড়ুনঃ  লুট হওয়া ৩০৯ অস্ত্র উদ্ধার: পুলিশ সদরদপ্তর

রাজশাহীতে টিসিবির ট্রাককে ঘিরে তৈরি হয়েছে জটলা। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য সংগ্রহ করতে দেখা গেছে মানুষকে। তাদের একজন ভ্যানচালক আবুল কাশেম। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই আমি। সকাল থেকে লাইন ধরে বসে আছি। এখনো পণ্য পাইনি। আমার মতো অনেকেই ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের রাজশাহী, সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি)

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন