শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কৃত্রিম চালের পুষ্টিহীন দাপট

কৃত্রিম চালের পুষ্টিহীন চমক

দেশে চালের বাজারে দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে মিনিকেট আর নাজিরশাইল নামের চাল। অভিজাতধারার অপ্রতিদ্বন্দ্বী এসব সুদৃশ্য চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে অনেক বেশি দামে। কিনেও নিচ্ছেন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের ক্রেতারা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মিনিকেট কিংবা নাজিরশাইল নামে দেশে কোনো ধান নেই, বা জন্মেও না। অথচ বাজার সয়লাব হয়ে গেছে এসব কাল্পনিক ধানের চালে। মূলত, নানা জাতের চাল ছাঁটাই করেই মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে বিক্রি করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে কাল্পনিক ধানের নামে চালের ব্যবসা। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

তবে বিপদের কথা হচ্ছে, ছাঁটাই বা পলিশড করার কারণে চালের পুষ্টিমান কমে যাচ্ছে ৬০ শতাংশের বেশি। শুধু তাই নয়, ছাঁটাই করা চালের বাকি অংশ চোরাইপথে পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। বছরে পাচার হওয়া চালের পরিমাণও কম নয়, প্রায় ২৫ লাখ টন। এতে একদিকে যেমন খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে, তেমনি পুষ্টিহীনতা বেড়ে যাচ্ছে। এমন উদ্বেগের তথ্য তুলে ধরেছে একটি গবেষণাপত্র। সম্প্রতি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ‘নিউট্রিশন অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসেসমেন্ট অব পলিশড রাইস সোল্ড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণায় এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণাপত্রের একটি কপি এসেছে দৈনিক আনন্দবাজারের হাতে।

গবেষণা কাজ পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, ছাঁটাইয়ের (পলিশ) ফলে চালের পুষ্টিমান প্রকার ভেদে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাচ্ছে। আবার চালকলগুলো একটি চালের দানা ১৮ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাই করছে। এই ছাঁটাইয়ের অর্ধেকটা কমানো সম্ভব হলে ২৫ লাখ টন চাল সাশ্রয় হবে। বর্তমানে এটি প্রাণিখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার রাইস ব্রান তেলের উপাদান হিসেবেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার হচ্ছে অবলীলায়।

গবেষক আব্দুল আলীম জানান, চালের ছাঁটাই ৮ শতাংশ বা তার কম হলে এর পুষ্টিমান বজায় থাকে। আর চালে পানির পরিমাণ রাখতে হবে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ। তিনি আরো জানান, ছাঁটাইয়ের পরে সেই চালের পেস্ট দিয়ে বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে প্রাণিখাদ্য তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভারতে পাচার হচ্ছে। এমনকি প্রাণিখাদ্যও দেশটিতে পাচার হচ্ছে। মূলত এর মাধ্যমে মূলত চালই পাচার হচ্ছে। এসব (পলিশ ও পাচার) অর্ধেক রোধ করা সম্ভব হলে প্রায় ২৫ লাখ টন চাল সাশ্রয় করা সম্ভব।

এদিকে খাদ্যঘাটতির দিকে নজর দিলে দেখা যায়, প্রতিবছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হলেও সরকারকে খাদ্যসামগ্রী বা চাল কিনতেই হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে বছরে চালের চাহিদা দুই কোটি ৮০ লাখ টনের বেশি। এর সঙ্গে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যুক্ত করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে চালের চাহিদা তিন কোটি ৫৩ লাখ টনের কাছাকাছি।

আরও পড়ুনঃ  ইতালিতে ফের লকডাউন

এখন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের দিকে তাকালে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৮৭ লাখ টন চাল। যেখানে ৩৪ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত। অথচ বলা হচ্ছে, দেশে চালের ঘাটতি রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আর সেই ঘাটতি থেকেই দেশে বছরে চাল আমদানির পরিমাণ ৩৯ লাখ টনের কাছাকাছি। তাহলে প্রশ্ন থাকে প্রায় ৭০ লাখ টন চালেল গন্তব্য কোথায়?

চালের উৎপাদন আর সরবরাহের ক্ষেত্রে শুভঙ্করের এই ফাঁকি ঠেকাতে গবেষক ড. আব্দুল আলীম দুটি পরামর্শ দিয়েছেন। যা বাস্তবায়ন করলে চাল নিয়ে যে বিব্রতকর সংকট তার কিছুটা সমাধান হতে পারে। প্রথমত, স্বীকৃত ধান ব্যতীত অন্যকোনো নামে চাল বাজারজাতকরণ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, ভোক্তার অধিকার রক্ষায় মোড়কের গায়ে চালের জাতের নাম লিখতে হবে। ড. আব্দুল আলীমের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি চার মাস ধরে চালের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে বিচার বিশ্লেষণ করে যে তথ্য বা ফলাফল প্রকাশ করেছেন তারই আলোকে এই পরামর্শ দিয়েছেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সরকার পুষ্টিসমৃদ্ধ ও নিরাপদ খাদ্য নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করতে যে জাতের চাল সে নামেই ব্রান্ডিং করতে হবে। তিনি গবেষণা সম্পর্কে বলেন, এর মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল খাবারের ব্যাপারে সবাই উৎসাহিত হবেন।

গবেষণায় দেখানো হয়, সিদ্ধ ব্রি ধান-২৮ ব্রাউন রাইসে প্রতি ১০০ গ্রামে প্রটিনের পরিমাণ থাকে ৮ দশমিক ৮ (গ্রাম), ফ্যাট থাকে ১ দশমিক শূন্য, সিএইচও ৭৭ দশমিক ১। ভিটামিন বি-১ থাকে শূন্য দশমিক ১৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ থাকে শূন্য দশমিক শূন্য ২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৩ থাকে ৩ দশমিক ৮৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ থাকে শূন্য দশমিক ২১ ও ভিটামিন বি৯ থাকে ১২ দশমিক শূন্য।

আরও পড়ুনঃ  রাঙ্গুনিয়ায় তথ্যমন্ত্রীর রোগমুক্তি কামনায় দোয়া

সিদ্ধ ব্রি ধান-২৮ ৫ শতাংশ ছাঁটাই করলে প্রতি ১০০ গ্রামে প্রোটিনের পরিমাণ নেমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৪ (গ্রাম), ফ্যাট থাকে শূন্য দশমিক ৯, সিএইচও ৭৭ দশমিক ৮। ভিটামিন বি-১ থাকে শূন্য দশমিক ১২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ থাকে শূন্য দশমিক শূন্য ১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-৩ থাকে ৩ দশমিক ১৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ থাকে শূন্য দশমিক ১৮ ও ভিটামিন বি৯ থাকে ৭ দশমিক শূন্য।

গবেষণায় বলা হয়, যদি ৫ শতাংশ ছাঁটাই করা হয় তবে ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রোটিন কমে যায়। ফ্যাট কমে ১০ দশমিক শূন্য শতাংশ। সিএইচও অর্জন হয় শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ ও ভিটামিন বি১ কমে ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। সিদ্ধ ব্রি ধান২৮ ১০ শতাংশ ছাঁটাই করলে প্রতি ১০০ গ্রামে প্রোটিনের পরিমাণ নেমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ২ (গ্রাম), ফ্যাট থাকে শূন্য দশমিক ৮, সিএইচও ৭৮ দশমিক ৬। ভিটামিন বি১ থাকে শূন্য দশমিক ১১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ থাকে শূন্য দশমিক শূন্য ১৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৩ থাকে ৩ দশমিক মুন্য ৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ থাকে শুন্য দশমিক ১৮ ও ভিটামিন বি৯ থাকে ৬ দশমিক শূন্য। তাতে, ১০ শতাংশ ছাঁটাইয়ে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রোটিন কমে যায়। ফ্যাট কমে ২০ দশমিক শূন্য শতাংশ। সিএইচও অর্জন হয় এক দশমিক ৯৫ শতাংশ ও ভিটামিন বি১ কমে ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

গবেষণায় আতপ চাল সম্পর্কে বলা হয়, ব্রি ধান২৮ ব্রাউন রাইসে প্রতি ১০০ গ্রামে প্রোটিনের পরিমাণ থাকে ৯ দশমিক শূন্য (গ্রাম), ফ্যাট থাকে ১ দশমিক ১, সিএইচও ৭৬ দশমিক ৭। ভিটামিন বি১ থাকে শূন্য দশমিক ১৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ থাকে শূন্য দশমিক শূন্য ২১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৩ থাকে ৩ দশমিক ৯৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ থাকে শূন্য দশমিক ২৩ ও ভিটামিন বি৯ থাকে ১১ দশমিক শূন্য। ব্রি ধান২৮ ৫ শতাংশ ছাঁটাই করলে প্রতি ১০০ গ্রামে প্রটিনের পরিমাণ নেমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ (গ্রাম), ফ্যাট থাকে ১ দশমিক শুন্য, সিএইচও ৭৭ দশমিক ৫। ভিটামিন বি১ থাকে শুন্য দশমিক ১১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ থাকে শুন্য দশমিক শুন্য ১৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৩ থাকে ৩ দশমিক ২৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ থাকে শুন্য দশমিক ১৯ ও ভিটামিন বি৯ থাকে ৬ দশমিক শুন্য।

আরও পড়ুনঃ  নুসরাত হত্যা রায়ের গুরুত্ব দিয়েছে বিশ্ব গণমাধ্যম

গবেষণায় বলা হয়, যদি ৫ শতাংশ ছাঁটাই করা হয় তবে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্রটিন কমে যায়। ফ্যাট কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সিএইচও কমে ১ দশমিক শুন্য শতাংশ। ভিটামিন বি১ কমে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ (মিলিগ্রাম)। আতপচালে ১০ শতাংশ ছাঁটাই করলে প্রতি ১০০ গ্রামে প্রটিনের পরিমাণ নেমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬ (গ্রাম), ফ্যাট ১ দশমিক শুন্য, সিএইচও ২ দশমিক শুন্য। ভিটামিন বি১ কমে ৩৫ দশমিক ৭ মিলিগ্রাম।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন