রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় বাজেটের ২৮ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব

শিক্ষা, স্বাস্থ্যশিক্ষা, ক্যাডেট, ধর্মীয়সহ (মাদরাসা, টোল তথা- মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসব) সবশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যশিক্ষাখাতে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস।

শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় ভার্চুয়ালি ‘প্রাক-শিক্ষাবাজেট: উন্মুক্ত আলোচনা’ শীর্ষক সভাটির আয়োজন করা হয়।
সংগঠনটির আহ্বায়ক ফারুক আহমাদ আরিফ বাজেট প্রস্তাবে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ১৭ হাজার ৩০০ ও পরিচালনে ১ লাখ ৭৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ জাতীয় বাজেটের ২৮ শতাংশ (শিক্ষায় ২৩ ও স্বাস্থ্যে ৫ শতাংশ)। জাতীয় আয়ের (জিডিপি) হিসেবে তা ৯ শতাংশ। কেননা যেকোনও দেশের শিক্ষাবাজেট সেই দেশের মোট বাজেটের ন্যূনতম ১৫-২০% বা জাতীয় আয়ের ৪-৬% হওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্যখাতের জন্য মোট ১ লাখ কোটি টাকা। তাতে উন্নয়ন ৬০ হাজার কোটি ও পরিচালন ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। (তার সঙ্গে জাতীয় বাজেটে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ৫ লাখ কোটি টাকা প্রয়োজন, যা আমাদের আগামী জাতীয় স্বপ্নবাজেটে বিস্তারিত আলোচনা হবে)। কেননা অশিক্ষিত, অসুস্থ ও বেকার জনশক্তি দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন অসম্ভব।

তিনি আয়ের উৎস সম্পর্কে বলেন, এই বাজেটে সরকার দেবে ২ লাখ ৮১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ও বেসকারি উদ্যোগে আসবে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাজেটবণ্টনের বিষয়ে বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ও মাদরাসা, কারিগরি ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ও উচ্চশিক্ষায় ১ লাখ ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ও ৬১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা নবম হতে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য বরাদ্দ থাকবে। বাকি ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যাংক ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা ব্যাংক নামে পৃথক দুটি ব্যাংক সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষাসংক্রান্ত সব লেনদেন ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সব লেনদেন ব্যাংক দুটি থেকে হবে। প্রথম শ্রেণি হতে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রতি ব্যয়টি জনপ্রতি হিসেব রাখা হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনব্যাপী একটি মাত্র ব্যাংক একাউন্টেই যাবতীয় হিসেব অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

আরও পড়ুনঃ  জামালপুরে বন্যার পানিতে ডুবে তিন শিশুর মৃত্যু

দক্ষিণ কোরিয়াতে শিক্ষাবাজেটের ৪ শতাংশ দেয়া হয় গবেষণার কাজে। ১৯৯০ সালে তাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৫ হাজার মার্কিন ডলার আর গবেষণার কারণে বর্তমানে তা ৩০ হাজার ডলারে পরিণত হয়েছে। ভারতে যেখানে একজন অধ্যাপকের বেতন আড়াই লাখ রুপি সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার। এই টাকায় সে সংসার চালাবে না পড়ালেখা করাবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। ফলে ভালো শিক্ষার্থীগুলো দেশ ছেড়ে চলে যায়।

সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অ্যান্ড চেয়ারপার্সন সজীব সরকারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া।

তিনি বলেন, ৮০ দশকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মুহাম্মদের কার্যকরী নেতৃত্বে দেশটি উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা আমাদের দেশে আসতো শিক্ষা নিতে এখন উল্টো তাদের দিকে আমাদের যেতে হচ্ছে। এটাকেই বলে নেতৃত্ব। সেখানে শিক্ষার গুণমত মান ও গবেষণা বাড়ানো হয়েছে। আমাদের দেশে গবেষণায় বরাদ্দ অপ্রতুল ফলে ভালো কাজ করা সম্ভব হয় না।

ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় যেতে হবে। আন্তর্জাতিক আলোকে সমন্বয় করতে হবে। গতানুগতিক সাবজেক্ট খুললে চলবে না। শিক্ষকদের স্বাধীনতা না থাকলে কিভাবে সঠিক জাতি গঠন করা যাবে। মাদরাসা শিক্ষাকেও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় আনতে হবে। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবান্ধব। তার কাছে কথাগুলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা দেশের উন্নয়নে তিনি কাজ করছেন। তাকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, শিক্ষায় বাজেট বাড়াতে হবে। গবেষণায় বাজেট বাড়াতে হবে। দেশের কৃষিতে উন্নয়ন তো গবেষণার ফলেই হয়েছে। অতএব অর্থ লাগবে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে।

আরও পড়ুনঃ  স্বাস্থ্য বিধি মেনে ফের উন্নয়নকাজ শুরু: কাদের

দেশের সব পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষা বিষয়ে কথা বলতে ও পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান তিনি।
সংগঠনটির যুগ্ম-আহ্বায়ক এনায়েতুল্লাহ কৌশিক ও জীম মণ্ডলের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের প্রধান ও সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব, অধ্যাপক ডা. মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল)-এমবিবিএস। সম্মাননীয় আলোচকদের মধ্যে মাহবুবুর রহমান (আলমগীর) সাবেক সাধারণ সম্পাদক অফিসার্স পরিষদ ও সংস্থাপন রেজিস্টার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আফজালুর রশিদ, সভাপতি; বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ মঞ্চ, নিয়ন মতিয়ুল বার্তা সম্পাদক-দৈনিক আনন্দবাজার, ওয়াহিদ সোহান, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট মালয়েশিয়া, রঞ্জিত বর্মন- সিনিয়র শিক্ষক; সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, এএসএম সুজাউদ্দীন সাংবাদিক, ইঞ্জি. আরিফ চৌধুরী শুভ, সাজিয়া ইফ্ফাত-লিডার অব রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস ইউনিট, আঁচল ফাউন্ডেশন।

সভাপ্রধানের বক্তব্যে সজীব সরকার বলেন, মানুষের জীবনমান উন্নত করতে হলে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে শিক্ষাখাতে। এক্ষেত্রে বাজেটের বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটির বাস্তবায়ন সঠিক ও স্বচ্ছ হচ্ছে কিনা তা তদারকি করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল) বলেন, দেশে স্বাস্থ্যশিক্ষায় ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। প্রতিটি জেলায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনসহ বিভিন্ন ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি মিলে একশর বেশি মেডিকেল, নার্স ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। তবে এখাতে শিক্ষক সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদা মাফিক শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও স্বাস্থ্যখাত সম্প্রসারণ করাটা ভালো দিক। কেননা কবে এতো সংখ্যক শিক্ষক তৈরি হবে তখন তা সম্প্রসারণ হবে তা তো হয় না। বিশেষ করে বেসিক সাইন্স, এ্যানাটমি, বায়োকেমিস্ট্রি ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষক হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

মাহবুবুর রহমান আলমগীর বলেন, বৈষম্য নিরসনের জন্যই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু এখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। সরকারি এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে একই সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে কর্মচারীদের জীবন মানের দিকে লক্ষ্য রেখে বেতন স্কেলের ২০টি ধাপের পরিবর্তে ১৫টি ধাপ করা যেতে।

আরও পড়ুনঃ  ১০ হাজার মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিবে ‘সঙ্গে আছি’

রঞ্জিত বর্মন ৮ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, ১. উপকূলীয় মন্ত্রণালয় গঠন বা উপকূলীয় বোর্ড গঠন করা। ২. উপকূলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ছোট একটি অংশের শিশুরা পরিবারের আর্থিক দুরবস্থাহেতু জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন সময়ে নদীতে পোনা ধরে আয়ের উৎস হিসাবে। উপকূলের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নে শিশুদের উপবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি করা, স্কুলে দুপুরে সরকারিভাবে খাদ্যের ব্যবস্থা করা।

নিয়ন মতিয়ুল বলেন, বৈশ্বিক জ্ঞান বিস্ফোরণের সঙ্গে আমাদের প্রজন্মকে পরিচয় করাতে, সেই সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে বিজ্ঞান শিক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে। সারাবিশ্বে শিক্ষা বাজেট বাড়ে, আমাদের দেশে কমে। এর পেছনে একমাত্র কারণ আমরা শিক্ষা ব্যয় বলি, বিনিয়োগ বলি না।

তিনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে বিজ্ঞান শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোসহ ১০ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। ১. চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে বাজেটে শিক্ষাকে চতুর্থ নয়, এক নম্বর অবস্থানে আনতে হবে। ২. শিক্ষাখাতের বরাদ্দকে ব্যয় হিসেবে নয়, বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। ৩. গবেষণা বা বিজ্ঞানাগারের পরিধি বাড়াতে হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে।

ওয়াহিদ সোহান বলেন, মালয়েশিয়ায় শিক্ষক ও অন্যান্যখাতে বেতন কাঠামো প্রায় সমান। ফলে শিক্ষকরা সঠিকভাবে পাঠদানে মনযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশেও তা করা যায়। কেননা দেশটি টেকনিকেল, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাখাতে বাজেটের ২৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্ধ দিচ্ছে। শিক্ষকদের সামাজিকস্তর ঠিক রাখতে পদন্নতি, গ্রেড, বেতনকাঠাসোসহ সবকিছু সমান রেখেছে। তা ছাড়া বাজেটের বিশাল অংশ গবেষণায় ব্যয় করা হচ্ছে।

আফজালুর রশিদ বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ড. মুহা. কুদরাত-এ-খুদার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হতে দেখলাম না। অথচ সেসবের ৯০ শতাংশ এখনো কার্যকর করা দরকার। তিনি শিক্ষক নিয়োগে কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখেন।

আনন্দবাজার/টি এস পি

সংবাদটি শেয়ার করুন