খাদ্য অধিদপ্তরের ডিলার হরিপদ মজুমদার বলেন, ‘মানুষ অনেক সকালে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমরা ২০০ জনকে দিতে পারি, কিন্তু মানুষ আসেন চারশর বেশি। আমরা যতটুকু বরাদ্দ পাই, ততটুকু লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের দিয়ে দিই। এক মাস ধরে অনেক নতুন মুখের মানুষ আসছেন, যারা কখনও চালের জন্য শহরে আসেননি।’
নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। তুলনামূলক কিছুটা কম দামে পণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকের সামনে ক্রেতার ভিড় বাড়ছে। অগত্যা নিম্ন মধ্যবিত্তরাও ওই ভিড়ে যুক্ত হচ্ছেন। ফলে ক্রমাগতই ক্রেতার সারি দীর্ঘ হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার মানুষ টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটলেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সেই সুযোগ নেই। সেখানে ভরসা সরকারের ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) কার্যক্রম। কিন্তু শুধু পৌর এলাকাকেন্দ্রিক এই কার্যক্রম গ্রাম পর্যায়ে না থাকায় গ্রামের মানুষ ছুটছেন জেলা ও উপজেলা সদরে। সেখানে ওএমএস ডিলারদের দোকানের সামনে ভিড় করছেন তারা। কিছুটা কম দামে পণ্য কিনতে সেখানে তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভোগ্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনভোগান্তির চিত্র উঠে এসেছে উত্তরের বিভিন্ন শহরে।
‘দোকান থাকি কিনিবার গেইলে সবচেয়ে কম দামের চাউলের দাম ৪০ টাকা, তার উপরোত ৬০-৭০ টাকারও আছে, অত দামের চাউল কিনি খাওয়া খুব কষ্ট হয়ছে হামার। এই জন্যে ওএমএসের এইঠে আসুনু, এইঠে ৩০ টাকা দরে চাউল পাওয়া যায়। খুব ভিড় ছিল, তাও পাঁচ কেজি চাল পানু।’
বলছিলেন নীলফামারী শহরের গাছবাড়ী পয়েন্টে খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) চাল নিতে আসা ৫৫ বছর বয়সী বিধবা ফিরোজা বেগম। তার বাড়ি সদর উপজেলার খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের হালিরবাজার গ্রামে। এই চাল নিতে এসেছেন রংপুর শহরের স্টেশন এলাকার তাসলিমা বেগম, শান্তি বালাসহ তিন শতাধিক মানুষ। এই পয়েন্টে ১০০ জনের কাছে এক টন চাল এবং ১০০ জনের কাছে এক টন আটা বিক্রি করা হয় এদিন। চাল ও আটা না পেয়ে ফেরত যেতে হয়েছে ১০০ জনকে।
চাল না পেয়ে এক রিকশাচালক জানান, শুধু শহরের নয়, গ্রাম থেকেও এখানে ওএমএসের চাল-আটা নিতে আসছে মানুষ। বিশেষ করে গত এক মাস থেকে নতুন নতুন মুখ আসছে। এখন গ্রাম পর্যায়েও খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি করা দরকার। তিনি জানান, ওএমএসে চাল ৩০ টাকা এবং আটা ১৮ টাকা দরে কেনা যায়। দোকানে চাল ন্যূনতম ৪০ টাকা কেজি এবং আটা ৩০-৩৫ টাকা কেজিতে কিনতে হয়।
খাদ্য অধিদপ্তরের ডিলার হরিপদ মজুমদার বলেন, ‘মানুষ অনেক সকালে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এক মাস ধরে অনেক নতুন মুখের মানুষ আসছে, যারা কখনও চালের জন্য শহরে আসেনি।
সৈয়দপুর শহরের রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় এসেছেন চল্লিশোর্ধ্ব শাহজাহান আলী। কাপড়ের ফেরি করেন। বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাচ্ছেন। জানান, এখন বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছেন দীর্ঘ লাইনে। এর আগে কোনোদিন দাঁড়াতে হয়নি। লালমনিরহাটের কালিবাড়ি মোড়, মিশন মোড়, স্টেশনের সামনে ওএমএস ডিলার শপের সামনে দেখা গেছে দীর্ঘ সারি। নারী, পুরুষের পাশাপাশি শিশুরাও দাঁড়াচ্ছে লাইনে।
কুড়িগ্রাম স্টেশন এলাকায় ওএমএসের চালের জন্য লাইনে দাঁড়ানো রোকসানা বেওয়া বলেন, ‘সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়েছি। ১০টার দিকে চাল বিক্রি শুরু হয়। পাঁচ কেজি চাল ও আটার জন্য এক- দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। এর পরও কিনতে পারলে খুশি।’ ডিলার গুলজার হোসেন জানান, ‘ক্রেতার চাপ বেশি থাকায় চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছি। বিক্রির জন্য যে চাল ও আটা বরাদ্দ পেয়েছি, তা উপস্থিত মানুষের তুলনায় খুব কম।’
খাদ্য বিভাগ জানায়, রংপুর বিভাগের ৫৮ পৌর এলাকায় ১২৫ ডিলারের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে। দুই টন করে সপ্তাহে দুই দিন এসব পণ্য বিক্রি করেন। নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন বেড়ে চলায় টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইন দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। কিছুটা কম মূল্যে পণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়া ক্রেতার ভিড় সামাল দিতে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানান, এখন চাহিদা বেড়েছে। ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ডিলার সংখ্যা ও বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম হুসাইন বলেন, ‘সরকার খেটে খাওয়া মানুষদের পাশে থাকতে বদ্ধপরিকর। নিম্ন আয়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে বরাদ্দ ও ডিলার সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। যেন সব ক্রেতা চাল-আটা কিনতে পারেন।’
রংপুর বিভাগের গ্রামে গ্রামে ওএমএস চালু করার দাবি জানিয়েছেন কৃষক ও ক্ষেতমজুর নেতারা। জাতীয় কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর ইউনিয়নের জেলা সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, ‘ওএমএসের সুবিধা ইউনিয়ন পর্যায়ে বাড়ানো দরকার। গ্রামের মানুষও বিপাকে পড়েছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে অত্যন্ত তিনজন ডিলারের মাধ্যমে চাল-আটা বিক্রির দাবি জানাই।’
রংপুর বিভাগীয় খাদ্য কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, ওএমএসের পয়েন্টগুলোতে ভিড় বেড়েছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী চাল-আটা বিক্রির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ডিলারদের। ডিলার পয়েন্টে খাদ্য বিভাগের কর্মীরাও কাজ করছেন। এরই মধ্যে অনিয়ম করায় ২১ জন ডিলারকে জরিমানা করা হয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক