সংকটটা যুদ্ধ শুরুর বছর কয়েক আগে থেকেই ডালপালা মেলছিল। অনেকেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলেন। সম্ভাব্য উপায় নিয়ে ভাবনা চিন্তাও শুরু করেছিলেন। নানা রকম যুদ্ধ-সংঘাত আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এমনিতেই বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনে টান পড়ছিল। তার ওপর আবার টানা দুই বছর ধরে করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডব। এসবের নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়েছে গিয়ে বিশ্বজুড়ে খাদ্য উৎপাদনের ওপর।
জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা সংক্রান্ত বিভাগ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলি বলছেন, যুদ্ধ-সংঘাত, জলবায়ু, করোনা-সব মিলিয়ে ভয়ংকর দুর্যোগ তৈরি হয়েছে আগেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর বছর চারেক আগেও বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র আট কোটি। আর চার বছরের মাথায় সেই সংখ্যা এখন তিনগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৭৬ লাখে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ডেভিড বিসলি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম বেড়ে গিয়ে পৃথিবীতে এখন নরক নেমে আসতে পারে। তার এমন সতর্কবাণী অনেকের কাছে মহাআতঙ্কের কারণ হতে পারে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান বলছেন, রাশিয়া আর ইউক্রেন দুটি দেশই বিশ্বে প্রধান খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক। চলমান যুদ্ধের কারণে তাই খাদ্যের দাম এত বেশি বেড়ে যেতে পারে যে, বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের জন্য তা নিশ্চিতভাবে বিপর্যয় ডেকে আনবে। খাদ্যশস্যের যে সংকট তৈরি হবে বা হচ্ছে, সেটা কিন্তু কোনো কোনো দেশে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। যেমন- লেবাননের কথাই ধরুন। তাদের চাহিদার ৫০ ভাগ খাদ্যই দেশটি নিয়ে আসে ইউক্রেন থেকে। একই তালিকায় থেকে গেছে ইয়েমেন, সিরিয়া, তিউনিসিয়ার মতো দেশ। যারা ইউক্রেনের খাদ্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল।
শুধু এসব দেশেই কথাই ভাবছেন কেন, বিশ্বজুড়ে গমের যে চাহিদা রয়েছে তার ২৫ ভাগই সরবরাহ করে তো রাশিয়া আর ইউক্রেন। তাছাড়া সূর্যমুখী বীজ আর তেলের বিশ্বব্যাপী চাহিদার অর্ধেকেরই যোগানদাতা রাশিয়া-ইউক্রেন। ভুট্টা বিক্রি করা দেশের তালিকার শীর্ষেও রয়েছে ইউক্রেন। বিশ্বে রুটির ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাতি পাওয়া ইউক্রেন বা রাশিয়া বিশ্ববাজারে যবের ১৯ শতাংশ, গমের ১৪ শতাংশ আর ভুট্টার ৪ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তথ্য উৎস থেকেও জানা যাচ্ছে, বিশ্বের ৬০ ভাগ সূর্যমুখী তেল রপ্তানি হয় ইউক্রেন থেকে। খাদ্যশস্য রপ্তানিতে বিশ্বের চতুর্থ থাকা দেশটির ওপর গম, ভুট্টাসহ খাদ্যসামগ্রীর জন্য নির্ভরশীল বিভিন্ন দেশ। বিশ্বের ৩০ শতাংশ গম ২০ শতাংশ ভুট্টা রপ্তানি হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। গম, ভুট্টা দিয়ে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে প্রাণিজখাদ্য উৎপাদন হয়। সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ৮০ শতাংশই করে এ দুই দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া। গত বছরে দেশটিতে ৭ কোটি ৬০ লাখ টন গম উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের হিসাব মতে, চলতি বছরের জুন-জুলাই মৌসুমে ৩ কোটি ৫০ লাখ টন গম রপ্তানি করবে রাশিয়া।
মোটাদাগে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশে জোগান আসে দেশ দুটি থেকে। চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্য সরবরাহে কতটা বিঘ্ন ঘটতে পারে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ছে না। চলমান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে থাকলে দেশ দুটি কতটা খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারবে আর পারলেও কতটা রপ্তারি করতে সক্ষম হবে তা নিয়ে অনিশ্চিয়তা থেকেই যাচ্ছে।
খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ খাদ্যশস্যের উৎপাদনের ওপর সবচেয়ে বড় প্রভাব সৃষ্টি করছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বে গমের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাও (এফএও) এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছে। বলছে, যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে পারে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। আর খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে যে অবধারিতভাবে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি কর্মসূচির মহাপরিচালক কিউ দোং আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, শীর্ষ দুই খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশের সংঘাতে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।
এফএও জানাচ্ছে, যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবের ফলাফল হিসেবে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিশ্বে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখ বেড়ে এক কোটি ৩ লাখে পৌঁছাবে। যার বড় প্রভাব থাকবে এশিয়াসহ আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল আর পূর্ব, উত্তর আফ্রিকার বেশ কিছু অঞ্চলে। এমন আশঙ্কা থেকেই জাতিসংঘের এই সংস্থাটি বিশ্বের অন্যান্য দেশকে রুশ পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ না করার আহ্বান জানিয়েছে।
বিবিসির খবরে ইভানা ডোরিচেংকো নামে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরোধবিষয়ক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। যিনি একজন ইউক্রেনীয় আইনজীবী। তার ভাষ্যমতে, ইউক্রেনের অনেক কৃষক এখন তাদের ক্ষেত-খামার ফেলে রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধে গেছে। বিবিসিকে তিনি আরো জানিয়েছেন, যেসব পুরুষে ফসলের মাঠে কাজ করার কথা, তারা দেশ রক্ষার জন্য লড়াইয়ের মাঠে গেছে। ইউক্রেনে এমন কাউকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না যারা দেশের লড়াইয়ে সাহায্য সহযোগিতা করায় ব্যস্ত নেই।
ইভানা ডোরিচেংকোর বক্তব্য থেকেই জানা যাচ্ছে, ইউক্রেনে কৃষি উৎপাদনের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। দেশটির সামরিক বাহিনী সব ধরণের বাণিজ্যিক জাহাজ পরিবহন স্থগিত রেখেছে। কোনো জাহাজই বন্দর ছাড়তে পারছে না, মালামালও তোলা হচ্ছে না। আমদানি কিংবা রপ্তানি সবই বন্ধ রয়েছে।
ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার এগ্রিকালচারাল বিজনেস চেম্বারের প্রধান অর্থনীতিবিদ মি. সিহলোবো বলছেন, হঠাৎ করে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটাই প্রথম বড় সমস্যা হিসেবে মনে হতে পারে। তবে এরপরই খাদ্য ঘাটতির প্রশ্নটি দেখা দেবে। তার তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুতেই কিন্তু খাদ্যশস্যের দাম ছিল কয়েকগুন। তখন কিন্তু যুদ্ধও বাঁধেনি। বিশ্বজুড়ে মন্দাও দেখা দিয়েছে। এসব কারণে ইতোমধ্যে বহু মানুষ সংকটে রয়েছে। যুদ্ধ সেই সংকটকে গভীর থেকে গভীরতর করতে পারে। সেই গভীর সংকটের ধাক্কাটা গিয়ে লাগবে আগে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।
বৈশ্বিক এমন এক সংকটময় মুহূর্তে মনে পড়ছে বিগত শতকে দক্ষিণ সুদানের কঙ্কালসার ক্ষুধার্ত শিশুর সেই ছবিটির কথা। সুদানে তখন চলছিল গৃহযুদ্ধ, অনিবার্যভাবে যার সঙ্গী হয় দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষ। ১৯৯৩ সালের ৬ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘দ্য ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটল গার্ল’ শিরোনামের সেই ছবিটি তুলেছিলেন কেভিন কার্টার। যার জন্য ১৯৯৪ সালে তার কপালে জুটেছিল পুলিৎজার পুরস্কার। ছবিটির থিম ছিল- একটি শিশু খাবারের জন্য লঙ্গরখানার দিকে যাচ্ছে। আর তার পেছনে একটি শকুন অপেক্ষা করছে শিশুটির মৃত্যুর জন্য। যাতে সেও তাকে খেতে পারে। অর্থাৎ দু’জনের লক্ষ্যই হচ্ছে ‘খাবার’, জীবন বাঁচাতে খাবার। নতুন শতাব্দীতে আর যাই হোক- এমন ছবি আর দেখতে চাই না আমরা।
আনন্দবাজার/শহক