আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস আজ
আজ ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। নদীমাতৃক এ দেশের নদীগুলো কালের বিবর্তনে মরা খালে পরিনত হচ্ছে। যে নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল আদি রংপুর-সেই ইছামতির নামও ভূলতে বসেছে এখানকার মানুষ। এমনি করে পানির অভাবে নাব্যতা হারিয়ে রংপুর অঞ্চলেরই প্রায় ৫০টি নদী এখন মৃতপ্রায়। সীমান্তবর্তী দেশ ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অর্ধশতাব্দী আগেও এসব নদীতে ছিল উত্তাল যৌবনে পানির প্রবাহ ও প্রাণের স্পন্দন। এখন সেই যৌবনে ভাটা পড়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে নদীর অস্তিত্ব। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি, পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
ইছামতি নদীর তীরে আদি রংপুর মাহিগঞ্জ গড়ে উঠলেও রংপুরের মানুষ ভুলতে বসেছে ইছামতির নাম। অথচ এই ইছামতির পাশে গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের বৃহত্তম বন্দর মাহিগঞ্জ। দেশবিদেশ থেকে অসংখ্য বড় বড় জাহাজ আসতো এ নদীর পাড়ে। বিশাল বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল মাহিগঞ্জ। ১৮৮৭ সালের ভয়াবহ বৃষ্টিপাত আর বন্যায় তিস্তা নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করলে ইছামতির প্রবাহ কমে আসে। কথিত আছে পীর হযরহত শাহজালাল বুখারি (রহ.) মাছ সাদৃশ নৌকায় করে ইছামতি নদী দিয়ে মাহিগঞ্জ এসেছিলেন বলে এলাকাটির নাম হয়েছিল মাহিসওয়ার থেকে মাহিগঞ্জ। বর্তমানে বাংলাদেশ পানি উন্নয়নবোর্ডের তালিকায় নেই এ নদীর নাম। বর্তমানে এ নদীর একটি ক্ষীণ ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। মাহিগঞ্জের পশ্চিমে শ্যামাসুন্দরী খালের সাথে এ নদীটির সংযোগ রয়েছে। মাহিগঞ্জের উত্তর-পশ্চিমে নাচনিয়ার বিলে অন্য প্রান্ত যুক্ত আছে। নদীটির প্রতি সরকারের কোন যত্ন নেই। এমনকি রংপুর সিটি করপোরেশনও নদীটি রক্ষণাবেক্ষণে কখনো কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ নদীর পাশে যারা নতুন বসতি গড়েছেন তারা এ নদীটির নামই জানেন না। তবে নদী পাড়ের প্রবীণ লোকজনদের ভাষ্য হচ্ছে এ নদীর নাম ইছামতি। এ নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল আদি রংপুর শহর।
দীর্ঘদিন নদী নিয়ে কাজ করেন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী একটি নদী ইছামতি। এ নদীর সাখে জড়িয়ে আছে রংপুরের সংস্কৃতির বিকাশ, সভ্যতার বিনির্মাণ। এরকম একটি নদীকে আমাদের অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। শুধু বর্ষা মৌসুমে নয়, বারোমাসই এ নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব, যদি সরকার এ নদী রক্ষাসহ এর সৌন্দর্য বিকাশের কাজ করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উত্তরের প্রাচীনতম জনপদ রংপুর অঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় রয়েছে ধরলা, করতোয়া, দুধকুমার, জলঢাকা, সতী ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙালী, বড়াই, মানাস, কুমলাই, ধুম, বুড়িঘোড়া, সোনাভরী, হলহলিয়া, লহিতা, ঘরঘরিয়া, নলেয়া, জিঞ্জিরাম, ফুলকুমার, কাঁটখালী, সারমারা, রায়ঢাক, যমুনেশ্বরী, চিতনী, মরা করতোয়া, ইছামতি, আলাই, ঘাঘট, তিস্তা, কুমারীসহ প্রায় ৫০টি নদী এখন মৃতপ্রায়। এসব নদীর অধিকাংশেরই এখন নাব্যতা নেই। বর্তমান সময়ে কোনো কোনো নদীতে হাটুজলও শুকিয়ে গেছে। একসময় এসব নদীর বুকে পাল তোলা নৌকায় পারাপার হলেও এখন পায়ে হেঁটে চলছে মানুষ।
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে’-রবীন্দ্রনাথ ঠাঁকুরের সেই ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার সাথে মিলে গেছে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার চিত্র। সর্বকালের সর্বনিম্ন পানি প্রবাহ এখন তিস্তায়। একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ এই নদী শুকিয়ে এখন মৃতপ্রায়।
সামান্য বর্ষার ছোবলে ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করা করতোয়া নদীও এখন পানি শুন্যতায় ধুকে ধুকে মরছে। কোথাও নেই আগের সেই প্রবাহ। নেই ডিঙ্গি নৌকা। ক্ষীণ এ নদীর প্রবাহ গাইবান্ধা ও বগুড়ায় প্রবেশ করে কিছুটা গতি পাওয়ার চেষ্টা করলেও তা এখন শুধুই ইতিহাস। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ওপর দিয়ে এক সময় প্রবাহিত আলাইকুড়ি নদী এখন পরিনত হয়েছে মরা খালে।
কালের আবর্তনে মরে যাচ্ছে রংপুরের গঙ্গাচড়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাঘট নদী। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় নদীটির বুকে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। আর কয়েকটি বছর পরে স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যাবে এই নদী। যার বুক জুড়ে লোকজন জবরদখল করে আবাদ করছে। নদীটি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বেকার হয়ে পড়েছে শত শত মৎস্যজীবী। অভিজ্ঞ লোকজনের ধারণা নদীটি খনন করা হলে মৎস্য চাষসহ আবাদী জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যাবে। এতে কৃষকরা উপকৃত হবে।
জানা যায়, নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার কুজিপাড়া গ্রামে তিস্তার শাখা নদী হিসেবে ঘাঘট নদীর উৎপত্তি। ঘাঘট নদী গঙ্গাচড়া উপজেলার পশ্চিম সীমানা দিয়ে নোহালী, আলমবিদিতর ও বেতগাড়ি ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে রংপুর সদর হয়ে পীরগাছা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর আলাইকুড়ি নদীর সঙ্গে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে।
নদীটির আঁকাবাঁকা পথে ১২০ কিলোমিটার শুকিয়ে গেছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, একসময় এ নদীটির ওপর দিয়ে পাল তোলা নৌকা চলতো। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো ব্যবসা করার জন্য। নদী পথে বিভিন্ন প্রকার পণ্য সরবরাহ করতো লোকজন। সেই নদীর শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ এখন শূন্যের কোঠায়। অথচ বর্ষাকালে নদীর ভাঙনে প্রতিবছর বিলীন হয়ে যায় কুলবর্তী মানুষের ঘরবাড়ি।
ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, নদীর সিকস্তি ও পয়স্তি আইন অনুসারে ঘাঘট নদীর বুকে জেগে উঠা জমিগুলো খাস জমির অন্তর্ভুক্ত। যা স্থানীয় লোকজন জবরদখল করে আবাদ করছে। একই অবস্থা মানাস নদীরও। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আমিনুর ইসলাম জানান, ভারত একতরফাভাবে পানিপ্রবাহ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এক সময়ের জনগুরুত্বপুর্ণ নদী দুটির গুরুত্ব এখন নেই। নদী খননের জন্য ছোট একটি প্রকল্প দেওয়া হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। সরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে নদী দু’টি খনন করলে এলাকার মানুষের অনেক উপকারে আসবে। একই কারণে রংপুর অঞ্চলের এমন প্রায় অর্ধশতাধিক নদীতে পানির অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এ ব্যাপারে রিভারাইন পিপল এর পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘এসব নদী পুণরুদ্ধার করতে হলে অবৈধ বাঁধ অপসারণ, নদীর তলদেশ খনন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উৎস মুখ উন্মোচন করে কৃত্রিম ক্যানেলের মাধ্যমে ছোট নদীগুলোর সঙ্গে বড় নদীর সংযোগ সাধন করা গেলে কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলের নদীগুলো আবার যৌবনে ফিরবে। ফের দেখা মিলবে খরস্রোতায় নদীপারের মানুষের ভাঙাগড়ার খেলা’।
তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে পানি প্রদানের আশ্বাসে বসে থাকলে কোনো লাভ হবে না। এমন প্রতিশ্রুতি আমরা একাধিকবার কান পেতে শুনেছি, কিন্তু কিছুই পাইনি। এজন্য আমাদের সরকারকেই কৃষি নির্ভর অর্থনীতির কথা ভেবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।