দেশে ২০০৪ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছরে ৩ হাজার ৭৫৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শুধু ২০১৮ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ৫৯১টি এ ধরনের হত্যা হয়।
তিন বছরের এসব ঘটনায় বন্দুকযুদ্ধে পুলিশ এবং ডিবি পুলিশের সংশ্লিষ্টতা আছে ২৩৫টি অর্থাৎ ৪৮.৫ শতাংশ, র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ান-র্যাবের সংশ্লিষ্টতা আছে ১৫৬টি অর্থাৎ ৩১.৯০ ও গুলিতে মৃত্যুতে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা ৬৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএস আয়োজিত “নির্বিচার প্রাণনাশ? বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড” শীর্ষক ওয়েবিনারে এ তথ্য তুলে ধরেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।
শনিবার সকাল ১০টায় সিজিএসের ওয়েবিনারে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন তিনি ।
ড. রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সাতটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা (প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, যুগান্তর, সমকাল, ঢাকা ট্রিবিউন, নিউ এইজ এবং মানবজমিন) এবং বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন থেকে পর্যালোচনার জন্য তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়।
তিনি বলেন, ৫৯১টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে দুই দল অপরাধীর মধ্যকার সংঘাতে এবং ৭টি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে চিহ্নিত করা যায়নি। ফলে ৫৬২টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে চিহ্নিত করা গেছে। এরমধ্যে পুলিশ এবং ডিবি পুলিশের সংশ্লিষ্টতা আছে ২৮৮টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে (৫১.২৪%) এবং র্যাবের সংশ্লিষ্টতা আছে ১৬২টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে (২৮.৮২%)।
ড. রীয়াজ বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো এতই বিস্তৃতি লাভ করেছে যে, ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৬টি জেলাতেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজার জেলায়।
সিজিএসের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিতে ও নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার মনজুর হাসান, এবং বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ও প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ২০১৯ সালে জাতিসংঘের একটি কমিটির বৈঠকে আইনমন্ত্রী বলেছেন যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় না। জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে- এর একটি সাক্ষাৎকারে আমির হোসেন আমু বলেছেন, জাতীয় প্রয়োজনে ক্রসফায়ার করা হয়। ড. আলী রীয়াজ বলেন, এসব বক্তব্যের মাধ্যমে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সরকার পরিকল্পিতভাবেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আসছে। মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার প্রধান আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দা কে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ পুলিশ পদক প্রদান করা হয়। এসব ঘটনা বাংলাদেশে আইনের শাসনের দুর্বলতাকেই প্রমাণ করে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দেশের সামরিক ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সাধারণ নাগরিকসহ অনেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমে আসে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য মতে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ১৭টি হেফাজতে মৃত্যু সংঘটিত হয়। যদিও এই সময়ে কোনো বন্দুকযুদ্ধ অথবা ক্রসফায়ার এর তথ্য পাওয়া যায়নি। বিএনপি সরকার- এর শাসনামলে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’- এর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই নিরাপত্তা অভিযানে অন্তত ৪০ জন ব্যক্তি তাদের আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল।
ড. আলী রীয়াজ মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর তথ্য তুলে ধরে বলেন, ২০০১-২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৩, হাজার ৪৫৩ জন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। একই সাথে আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক)- এর তথ্যানুযায়ী, ২০০৪-২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ১৬৫ জন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আনন্দবাজার/টি এস পি