মাতৃভাষা রক্ষায় বাঙালির রয়েছে বিপুল ত্যাগ-তিতিক্ষা। তবে দিনে দিনে উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলা ভাষা। প্রায় চার বছর আগে সরকারি এবং বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাংলায় দুটি বই পড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে তা মানছে না বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়। এবং তা মানানোর কোনো উদ্যোগও নেই ইউজিসির।
ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, বিশেষায়িত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে প্রকৌশল, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অনেকে বাংলা পড়াতে চায় না। এছাড়া বেসরকারি ১০৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৮টিতে বাংলা বিভাগ রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থী না পাওয়ায় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ চলছে নামকাওয়াস্তে।
২০১৭ সালে ইউজিসির পূর্ণ কমিশনের সিদ্ধান্তে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ ও ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নামের দুটি বিষয় যোগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ইউজিসির অনুরোধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনা করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পাদনা করেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমপক্ষে যাতে এই দুটি বিষয় পড়ানো হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনাও জারি করে ইউজিসি। নির্দেশনার পর চার বছর পার হয়ে গেলেও বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় তা মানছে না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তাদের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা কোর্স পরিচালনা করে। এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০’ অনুযায়ী। ওই আইনটিতে কোনো কোর্সে বাংলা বিষয় যোগ করার বাধ্যবাধকতা নেই। সেজন্য ইউজিসির পক্ষে অনুরোধ করাই শেষ উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সে অনুরোধে কর্ণপাত করছে না বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বর্তমানে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর জানান, আমরা সব শিক্ষার্থীর কোর্সে দুটি বাংলা বই যোগ করার নির্দেশনা দিলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তা মানছে না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বেশির ভাগ বিশেষায়িত প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আসলে উচ্চশিক্ষার পড়ালেখা বিষয়ভিত্তিক। ফলে তারা অন্য বিষয় যোগ করতে আগ্রহী না। সার্বিকভাবে উচ্চশিক্ষায় বাংলার চর্চা বাড়াতে হলে প্রয়োজনীয় বই দরকার। মৌলিক বইয়ের পাশাপাশি অনেক বই অনুবাদ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকেও বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন বাংলা মাধ্যমে। এই শিক্ষার্থীরাই যখন উচ্চশিক্ষায় আসেন, তখন বাংলা তথ্যসূত্র বইয়ের চরম সংকটে পড়েন। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিরুপায় হয়ে ইংরেজি তথ্যসূত্র বইয়ের দ্বারস্থ হন। বাংলায় প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র বইয়ের সংকট থাকায় গবেষণার উৎকর্ষও সাধন করা যাচ্ছে না।
ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫২। শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে ৫০টির। এর মধ্যে ১৬টি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। বাকি ৩৪টি বিশেষায়িত মেডিক্যাল, কৃষি, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষায়িত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগে বাংলা পড়ানো হয় না।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান জানান, জাপান, জার্মানি, চীনের মতো দেশ সবার আগে তাদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। নিজের ভাষা ব্যবহার করেই তারা উন্নতির শিখরে উঠেছে। অনেক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও ওই সব দেশের ভাষা শেখানো হচ্ছে। আমাদের মাতৃভাষাও আমাদের শিকড়। শিকড়কে গুরুত্ব না দিলে দেশ এগোতে পারে না।
আনন্দবাজার/ টি এস পি