নারিকেল সুপারির জেলা লক্ষ্মীপুরের আরিফ হোসেন পড়াশুনা করেছেন আলিয়া মাদ্রাসায়। আলিম পাস করে পরিবারের হাল ধরতে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই মাসিক ৪৬ হাজার টাকা বেতনে সেখানে বছর খানেক কাজ করেন। থাকা-খাওয়া খরচ বাদে সব টাকা পাঠিয়ে দিতেন দেশে। নিজের দক্ষতা বাড়াতে বছরখানেক পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন। নিরাপত্তা বিষয়ক এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষে একই কোম্পানিতে তিনি সেফটি অফিসার পদের জন্য আবেদন করেন। মৌখিক পরীক্ষায় পাস করার পর মাসিক এক লাখ টাকা বেতনে সেই পদে যোগ দেন। নিজের খরচ রেখে বাকি সব টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন।
প্রশিক্ষণের পর আরিফের নতুন চাকরির বয়স এখন দুই বছর। দক্ষতা অর্জনের আগের চেয়ে বর্তমানে তার বেতন বেড়েছে ৬০ হাজার টাকা। গত দুই বছরে তিনি বাড়তি আয় করেছেন ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক আরিফের মাধ্যমেই দেশে রেমিটেন্স আয় বেড়েছে মাসে ৬০ হাজার টাকা। বছর হিসাবে ধরলে যার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সাত লাখ ২০ হাজার টাকায়।
আরিফ হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, প্রশিক্ষণ ছাড়াই যখন বিদেশ চলে আসি তখন বেশি পরিশ্রম করেও বেতন ছিল কম। আর প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জনের পর ভালো পদে ভালো বেতনে চাকরি করছি। আগে কঠোর পরিশ্রম করে যা পেতাম এখন তারচে কম পরিশ্রমেই তিনগুণ পাচ্ছি। আরিফ তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রশিক্ষিত প্রবাসীরা বড় পদে চাকরি করে বেশি বেতন নিয়ে যাচ্ছেন। দক্ষতা বেশি বিধায় তারা বেশি বেতন পাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরের আরেক তরুণ পরানের গল্পটি অবশ্য ভিন্ন। দেশে তিনি সিএনজি অটোরিকশা চালাতেন। এতে যা আয় করতেন তা দিয়েই সংসার চলতো। তবে আরো সচ্ছল আর উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে তিনি মিনিবাস চালানো শিখে পাড়ি জমান বাংলাদেশের শ্রমশক্তির সবচেয়ে ‘বড় বাজার’ আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বের দেশ ওমানে। সেখানে গিয়ে অল্প বেতনে কাজ নেন একটি কোম্পানিতে। তবে কয়েক মাস পরেই নিজের একটা গাড়ি কেনেন। এরপর শুরু করেন কাঁচামালের ব্যবসা। কৃষিজমি থেকে হরেক রকমের সবজি কিনে নিজ গাড়িতে করে বিক্রি করতে থাকেন বিভিন্ন দোকানে। এতে তার আয় হয় লাখ লাখ টাকা।
অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে পরান দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দেশ থেকে গাড়ি চালানো শিখেই আমি ওমানে গিয়েছি। শুরুতে যে কোম্পানিতে কাজ করতাম সেখানে মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতন পেতাম। তবে এখন নিজেই ব্যবসা করছি। নিজের কেনা গাড়িতে করে বিভিন্ন দোকানে সবজি বিক্রি করি। এতে কোনো মাসে এক লাখ টাকা, কোনো মাসে আবার দেড় লাখ টাকা আয় হয়। আবার কখনও কখনও মাসে দুই লাখ টাকারও বেশি আয় হয়। পরান বলেন, দেশ থেকে যদি দক্ষতা অর্জন না করে না আসতাম তাহলে ৩০ হাজার টাকা আয় নিয়েই পড়ে থাকতে হতো। তিনি বলেন, আমার আগে বহু লোক বিদেশে এসেছে কোনো দক্ষতা না নিয়েই। যারা এখনও আগের বেতনেই পড়ে আছেন। বিদেশে দক্ষ লোকের কদর বেশি। দ্রুত ভালো বেতনে ভালো পদে কাজও জুটে যায়। তবে আমাদের দেশে দক্ষতাসম্পন্ন লোকের অভাব রয়েছে। সেজন্য কাঙ্ক্ষিত আয় হচ্ছে না অনেকেরই।
লক্ষ্মীপুরের আরেক তরুণ জয়নাল আবেদিন সোহাগ। পরিবারের হাল ধরতে প্রশিক্ষণ ছাড়াই আট বছর আগে হয়েছেন ওমান প্রবাসী। কনস্ট্রাকশন সেকশনে হেলপার হিসেবে কাজ করছেন। শুরুতে যে বেতনে কাজ করতেন আজও সে বেতন বাড়েনি। আট থেকে ১০ ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রমের পর মাস শেষে বেতন পান মাত্র ২৫ হাজার টাকা। নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে যে কয় টাকা হাতে থাকে তাই দেশে পাঠিয়ে দেন। কোনো রকমে চলে দেশের সংসার।
সোহাগ তার প্রবাসী জীবন সম্পর্কে দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করছি প্রবাসে। তবে ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। অথচ আমার পরে অনেকেই প্রবাসে এসে লাখ লাখ টাকা আয় করছে। দেশে বাড়ি করেছেন, জায়গা জমি কিনে স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। তারা প্রত্যেকেই দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। অনেকটা আফসোস করে এ প্রবাসী বলেন, যদি দক্ষ হয়ে দেশ থেকে আসতাম তাহলে এমন পরিস্থিতিতে পড়তাম না।
আরিফ, পরান বা সোহাগের মতো দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী খুব বেশি নেই প্রবাসে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব বাংলাদেশি বেশি উপার্জনের জন্য এসেছেন, তাদের বেশিরভাগেরই তেমন দক্ষতা নেই। কেউ হয়তো দেশে চাষাবাদ করতেন, কেউ ছোটখাট ব্যবসা সামলাতেন। অন্য কোনো বিষয়ে ভালো দক্ষতা তাদের ঝুলিতে নেই। বিদেশে এসে তারা যেমন ভালো পদে কিংবা ভালো বেতনে চাকরি পাচ্ছেন না। সেজন্য তারা বেশি টাকা বা রেমিটেন্স পাঠাতে পারছেন না। যদিও প্রশিক্ষণ ছাড়াও কেউ কেউ প্রবাসে বেশ ভালোই আছেন। তবে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা কাউকে খারাপ অবস্থায় থাকতে হয়নি কখনও।
বর্তমান বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির বড় শক্তি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। যেসব দেশের রেমিট্যান্স যতো বেশি সেসব দেশের রিজার্ভ ততো শক্তিশালী। তাদের জিডিপির আকারও ততো বড়। বিগত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভারসাম্য নির্ধারণ করছে প্রবাসী আয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্সে শুধু প্রান্তিক পর্যায়েই বদল ঘটেনি, বদলে দিয়েছে জিডিপির আকারও।
সূত্রমতে, বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখের বেশি। যাদের মধ্যে ১০ লাখের বেশি-ই নারী। তবে করোনা মহামারির সময় অন্তত সাড়ে চার লাখ শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। উন্নত জীবন আর বেশি আয়ের আশায় যারা বিদেশে যান তাদের বেশিরভাগেরই তেমন কোনো দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা থাকে না। প্রকৌশলগত বাড়তি জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা ভালো পদে কিংবা বেশি বেতনের চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। যা দেশের প্রবাসী আয়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে দেশে রেমিটেন্স এসেছিল ১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। মহামারি শুরুর বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে রেমিটেন্স আসে দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসের এটাই ছিল সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
প্রতি বছর দেশ থেকে আট থেকে নয় লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষতার অভাবে তারা অনেক কম বেতনে চাকরি করছেন। অথচ অন্যদেশের কর্মীরা দক্ষতার কারণে বেশি বেতন পাচ্ছেন। দেশের প্রায় এক কোটি কর্মী বিদেশে চাকরি করলেও রেমিটেন্সের পরিমাণ বাড়ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে পরিমাণ বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে তার তিন ভাগের এক ভাগও যদি প্রশিক্ষিত হতো তাহলে রেমিটেন্সের আকার আরও কয়েকগুণ বেশি হতো। শুধু দক্ষতার অভাবে বাড়ানো যাচ্ছে না রেমিটেন্স আয়। প্রবাসীদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে সরকারের বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাতে রেমিটেন্স আয় বর্তমানের তুলনায় আরো কয়েকগুণে বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। যাতে জিডিপির আওতা যেমন বাড়বে তেমনি অর্থনৈতিক ভিত্তি আরো শক্তিশালী হবে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, করোনার মধ্যে রেমিটেন্স বেড়েছে ঠিকই তবে করোনা কমে গেলে রেমিটেন্সও কমে যাবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, করোনাকালে টাকা পাঠানোর অবৈধ সব চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রেমিটেন্স বেড়ে গিয়েছিলো। তবে করোনা মহামারি শেষ হলে অবৈধ সব পথ আবারও সচল হয়ে যাবে। যাতে রেমিটেন্স কমে যাবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো বলেন, করোনার কারণে এককালীন সঞ্চয় নিয়ে অনেকে ফেরত এসেছেন, যা আগের উচ্চ প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাই এখন রেমিট্যান্স পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের বাজারের দিকে নজর দিতে হবে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ভোগ থেকে বিনিয়োগে আনার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ) নাফরিজা শ্যামা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েই প্রত্যেক প্রবাসী বিদেশে গেছেন। আমরা সবাইকেই প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে এসেছি। তবে লংটার্ম প্রশিক্ষণের আওতার বাইরে রয়ে গেছে বিশাল একটা অংশ। যার অন্যতম কারণ, বাবা, মামা, চাচা, খালুরা। যারা তাদের সন্তান, ভাতিজা ও ভাগিনাদের ভিসার ব্যবস্থা করে দিয়ে বিদেশ নিয়ে যাচ্ছেন। এতে ভিসার মেয়াদ বিবেচনায় তারা শর্টকোর্স করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবার অনেকেই অর্থ সঙ্কটের কারণে দ্রুত আয় করতে শর্টকোর্স করেই চলে যাচ্ছেন বিদেশে। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসছে না। আমরা চেষ্টা করছি দেশের নাগরিকদের দক্ষতার ভিত্তিতে প্রবাসে পাঠানোর জন্য।
আনন্দবাজার/শহক