ইউরোপ যেতে বয়স ছয় বছর বাড়িয়ে পাসপোর্ট করেছিলেন রাজীব মীর। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে দুবাই হয়ে লিবিয়া যান তিনি। দুই মাস সেখানে একটি ঘরের মধ্যে গাদাগাদি করে রাখা হয় তাঁকেসহ অন্য বাংলাদেশি ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের। খাওয়ার জন্য একবেলা রুটি পেত। একদিন মধ্যরাতে নৌকায় তুলে দেওয়া হয় তাঁদের। সাগর তখন উত্তাল। সকালে একটি হেলিকপ্টার আসে, তবে সাহায্য না করে সেটি চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই নৌকাটি উল্টে যায়। এরপর সাঁতরাতে সাঁতরাতে অনেকে মিলে নৌকাটি সোজা করেন। ১০৫ যাত্রীর অধিকাংশই আবার নৌকায় উঠতে পারেন। কিন্তু ১৬ জন বাংলাদেশি তলিয়ে যান। এক দিন পর লিবিয়ার সীমান্তে ফেরে নৌকাটি। পাড়ে নামার আগেই আফ্রিকার এক নারী মারা যান। আরও কয়েকজন মারা যান হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে। মাঝে স্যাটেলাইট ফোনে লিবিয়ায় থাকা দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাহায্য পাননি।
রাজীব মীর জানান, পাড়ে নামার পর মাফিয়া চক্র তাঁদের বিক্রি করে দেয় একটি গ্রুপের কাছে। তারা আটকে রাখে। টাকার জন্য চাপ দেয়। টাকা দিতে না পারায় মারধর করে। চার দিন পর বাড়িতে ফোন করেন। সাড়ে তিন লাখ টাকা পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। এরপর ত্রিপোলিতে এক স্বজনের কাছে যান। কিছুদিন পর কাজও শুরু করেন। তবে অসুস্থ হয়ে পড়েন; কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে থাকে। আরেক দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করে দেশে ফিরে ওই বছরের ডিসেম্বরে। এখনো মাঝেমধ্যে কাশির সঙ্গে রক্ত আসে জানিয়ে রাজীব বলেন, ‘বেঁচে ফিরেছি। এভাবে আর বিদেশে যেতে চাই না।’
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম বলছে, ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ বা মারা গেছেন ২২ হাজার ৮৪৫ জন। এর মধ্যে চলতি বছরে এ পর্যন্ত হারিয়ে গেছেন ১ হাজার ৫৫৯ জন। বেশির ভাগেরই মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। আবার উদ্ধার হলেও পাসপোর্ট না থাকায় অধিকাংশের পরিচয় নিশ্চিত করা যায় না।
সর্বশেষ গত ১৯ জুলাই তিউনিসিয়ার উপকূলে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পাঁচজন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার।
তবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছার ক্ষেত্রে গতবারের মতো এ বছরও দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন বাংলাদেশিরা। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ইতালিতে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে ২৮ শতাংশই তিউনিসিয়ার নাগরিক। এরপরই বাংলাদেশিদের অবস্থান, ১৩ শতাংশ।
বিদেশে যেতে নিয়মিত প্রতারিত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও মামলা করতে আগ্রহ দেখায় না অধিকাংশ ভুক্তভোগী পরিবার। জেলা পুলিশ সূত্র বলছে, অনেকেই মামলা করেন না। মামলা করার পর সমঝোতাও করেন অনেকে। তবে সম্প্রতি মানব পাচার আইনে মামলা করার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে মানব পাচার আইনে মামলা হয় দুটি। পরের বছর হয় মাত্র একটি। এ দুই বছরে কেউ গ্রেপ্তার হননি। ২০১৯ সালে তিনটি মামলায় তিনজন গ্রেপ্তার হন। পরের বছর মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১টিতে, আর গ্রেপ্তার হন ৩৫ জন। এ বছরের প্রথম ১০ মাসে (অক্টোবর পর্যন্ত) ৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
‘