জুবায়ের বাবু। একজন ব্রিটিশ চলচিত্র নির্মাতা। বাংলাদেশে টেলিভিশনের একজন পুরাতন মূখ হলেও বাংলা সিনেমায় অভিষেক হতে যাচ্ছে খুব শিগগিরই। দীর্ঘসময় প্রবাস জীবনে বিদেশি অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মাণ করতে চান বাংলা সিনেমা। চলচ্চিত্র নিয়ে নিজস্ব ভাবনাসহ অন্যান্য বিষয়ে কথা বলেছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ শফিক।
দৈনিক আনন্দবাজার: দেশে কবে ফিরছেন?
জুবায়ের বাবু: একবার গিয়েছি আবার যাবো খুব শিগগিরই। চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ কিছু নতুন পরিকল্পনা রয়েছে। দুটি গল্প নিয়ে কাজ করছি। তাছাড়া আমি ব্রিটেনে পড়াশোনা করেছি চলচ্চিত্র নির্মাণের উপরে। আমার মূল উদ্দেশ্যটাই ছিলো দেশে ব্যাক করে বাংলা সিনেমা বানানো।
দৈনিক আনন্দবাজার: তাহলে এখন নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা দেশবাসীকে দিতে যাচ্ছেন?
জুবায়ের বাবু: দেখুন, এই যে আমরা উন্নত বিশ্বের সিনেমাগুলো দেখি। এর পিছনে কিন্তু প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটা বড় অবদান রয়েছে। আমি মনে করি যে বিষয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। আর ফিল্মের উপর পড়াশোনা করার কারণে ব্রিটিশসহ বিদেশি চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক হয়েছে। আমি অনেক বড় বড় ফিল্ম মেকারের সঙ্গে চলাফেরা করেছি। অনেক কিছু শিখেছি। আমার মূল উদ্দেশ্যটাই ছিলো শেখা।
দৈনিক আনন্দবাজার: কেন চলচ্চিত্র সাবজেক্টকে বেচে নিলেন?
জুবায়ের বাবু: যেহেতু আমি বাংলাদেশে অনেক টেলিভিশন প্রোডাকশন করেছি। ফিল্মের প্রোডাকশন দেখেছি। আমি যখন একুশে টিভিতে প্রযোজক হিসাবে কাজ করি তখন প্রায় তিন বছরে ৪’শর মতো প্রোডাকশন তৈরী করেছি। সে সময় এটিকে সর্বোচ্চ প্রোডাকশন বলা যেতে পারে। আমি প্রোডাকশন করতে গিয়ে ঠেকে ঠেকে শিখেছি। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানিকভাবে নির্মাণের কৌশলগুলো শেখার কোন সুযোগ ছিলো না। সেই জায়গাটায় আমি মনে করেছিলাম একুশে টিলিভিশন আমরা একটা স্কুল হতে পারে এবং এই স্কুলে ভর্তি হই। সেই জায়গাটা থেকেই একুশে টেলিভিশনে কাজ করা ও শেখা ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করতে চাই। সেই জন্য আমি মনে করেছি আগে চলচ্চিত্রটা বুঝি এবং শিখি। ওই জায়গাটা থেকে আমি এখনো ছাত্র এবং শিখছি। পাশাপাশি আমি মরে করছি বাংলাদেশে এখন দারুণ একটা পরিবেশ। যেটি গত ১৬ বছর সব কিছু নিয়ন্ত্রিত ছিলো। এমনকি আপনার স্বাপ্নটাও নিয়ন্ত্রিত ছিলো। সুতরং সেই জায়গাটা থেকে মুক্তভাবে চিন্তা করে একটি ভালো চলচ্চিত্র তৈরি করবেন সেটা ছিলো একটা কঠিন ব্যাপার। এমনকি আমাদের অনেক ভালো ভালো চলচ্চিত্রও সেন্সরে আটকে দেয়া হয়েছে। যদি মনে করে তারা এই চলচ্চিত্রটি তাদের পক্ষে যাওয়া হচ্ছে না তাহলে তারা সেটা হতেই দেয়নি। এছাড়া যদি এও মনে করা হতো এই চলচ্চিত্রটির জন্য অন্যকোনও দেশ মাইন্ড করবে সেখানেও তারা বাধা দিয়েছে। এমন অনেক কথা আমরা জানি। সুতরাং এখন একটি মুক্ত পরিবেশ, নানা ধরণের গল্প আসছে। সো এখনই সময়। এখন আমি সময়টাকে ইউজ করতে চাই। আমার শেখাটা একটু ব্যবহার করতে চাই।
দৈনিক আনন্দবাজার: কবে নাগাদ আমরা সেটা দেখতে পারবো?
জুবায়ের বাবু: আমি খুব শিগগিরই বাংলাদেশে ফিরবো। আমি গল্পগুলোকে সাজাচ্ছি। কারণ গত ১৬ বছরে আমি অনেক কিছু চিন্তা করেছি। বাংলাদেশের জন্য আমার কী কী গল্প হতে পারে সেটা নিয়ে কাজ করেছি। গল্পগুলো আমার মাথায় গিজগিজ করছে। প্রতিদিনই আমাকে তাড়া দিচ্ছে। ঐ গল্পগুলোই আসলে বলার চেষ্টা করবো।
দৈনিক আনন্দবাজার: আপনার চলচ্চিত্রে কী কী ধরণের গল্প থাকছে?
জুবায়ের বাবু: আমি ব্যক্তিগতভাবে একটু ভিন্নধরণের গল্প পছন্দ করি। এক্ষেত্রে একটু রিয়েলিস্টিক এবং পাশাপাশি একটু থ্রিলার জাতীয় বা সাইকো থ্রিলার, এগুলো আমার একটু পছন্দ। আমি আমাদের দেশের গল্পই তৈরি করতে চাই। এমন গল্পগুলোই করতে চাই যেগুলোর বেসড অন ট্রু স্টোরি । সত্য কাহিনী অবলম্বনে যে চলচ্চিত্রগুলো তৈরি হয় এগুলো আমাকে খুব ডাকে। এধরণের ছবিগুলো আমি তৈরি করতে চাই। নির্মাণের ক্ষেত্রে আমি একটু চেষ্টা করবো ওয়েস্টার্ণ ধাঁচে তৈরী করতে ।
দৈনিক আনন্দবাজার: আপনার চলচ্চিত্রে কি কোনো ম্যাসেজ থাকবে?
জুবায়ের বাবু: দেখুন প্রতিটা ছবিতেই একটি মোরাল স্টোরি থাকে। প্রতিটি গল্পই কোননা কোনও ম্যাসেজ দিতে চায়। প্রতিটা গল্পেই কিন্তু একজন পরিচালক চায় তার একটা দর্শন উপস্থাপনের জন্য। তবে গল্পের ভেতরে সব সময় আপনার বিষয়টি কাজ করে সেটা কিন্তু নয়, তবে ছোট ছোট গল্পের ভেতরেও নিখুতভাবে অনেক কিছু যুক্ত করা যায়।
তবে যেহেতু চলচ্চিত্র একটি অনেক বড় মাধ্যম। সেখানে কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু করার আছে। তবে শুধুমাত্র শেখানোর জন্য আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো, আমি এই তন্ত্রে বিশ্বাসী না। আমি একটি ভালো চিলচ্চিত্র নির্মাণ করবো যেটি আমার ভালো লাগা। প্রথমে গল্পটা আমারই ভালো লাগতে হবে। আমারই যদি ভালো না লাগে সেই গল্পটি আমি দর্শককে কীখাবে ভালো লাগাবো। সুতরাং আমি ঐ জায়গাটাতে কাজ করতে চাই।
দৈনিক আনন্দবাজার: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কী কী ধরণের সমস্যা আছে বলে আপনার মনে হচ্ছে?
জুবায়ের বাবু: বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সমস্যা হচ্ছে- ডিস্ট্রিবিউশন পদ্ধতি। আপনি যদি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা চলচ্চিত্রকে নিয়ে যেতে চান তাহলে প্রথমে আপনাকে ডিডিস্ট্রিবিউশনটা বুঝতে হবে। এটি কীভাবে কাজ করে এটি বুঝতে হবে। আন্তর্জাতিক ভাবে মার্কেটিং এবং ডিস্ট্রিবিউশন এই দুইটা জায়গায় আমরা খুবই দুর্বল। এই জায়গাগুলোতে আমাদেরকে সফল হতে হবে। কারণ চলচ্চিত্র একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। তো এখানে একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক অনেক অর্থ লগ্নী করেন। এটা উঠাতে হবে। এটি একটি বড় ধরণের ফ্যাক্টর। আর দ্বিতীয়ত – আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে- সিনেমা হল। এক সময় আমাদের ১২ থেকে ১৩’শ হল ছিলো। সেই সিনেমা হল এখন এক-দেড়শ হয়ে গেছে। এখন এই মাত্র কয়েকটি সিনেমা হল দিয়ে কটি ইন্ডাস্ট্রি দাঁড় করানো অনেক কঠিন। অনেক টাকা লগ্নী হবে, অথচ ছবি চলবে না।
দৈনিক আনন্দবাজার: এক্ষেত্রে অনলাইন বা সোস্যাল মিডিয়া কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?
জুবায়ের বাবু: না, এটি হচ্ছে অপসনাল। একটা চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে তার মূল জায়গাটা হচ্ছে থিয়েটার। কারণ এটা বড় পর্দার জিনিস। ছোট পর্দার বিষয় না। টেলিভিশনের নাটক আর সিনেমা কিন্তু এক জিনিস না। দুইটার ল্যাংগুয়েজ ও ট্রিটমেন্ট কিন্তু ভিন্ন। সেক্ষেত্রে যে কোনও নির্মাতা চাইবে তার ছবিটা যাতে সিনেমা হলে চলে। এখন সিনেমা হলে যেখানে কম বা নাই সেখানে এই ইন্ডাস্ট্রি দাঁড় করানো বড় একটি চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি আরও একটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেটা হচ্ছে- অন্তর্জাতি মান। আমাদের সিনেমাগুলো ট্যাকনিক্যালি আন্তর্জাতিক মানের হয় না। তো সেই জায়গাটাতে কাজ করার একটি বিষয় রয়েছে। আর সাইন্ডের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে-আমরা বাহিরের অন লোকেশন সাইন্ড নিতেই পারি না। কারণ আমাদের দেশে বাহিরের এম্বিয়েন্ট সাউন্ড অনেক বেশি। যানবাহনসহ বিভিন্ন ধরণের শব্দের কারণে আমরা রিয়েল সাইন্ড ধরতে পারি না। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে ডাবিং করতে হচ্ছে। আর আমাদের ডাবিং থিয়েটারগুলো অনেক দুর্বল। আবার ছবি ডাবিং করলে সেখানে ফলি’র একটা ব্যাপার আছে। আমাদের ভালো ফলি ষ্টুডিও নেই। সো, সাইন্ড ডিজাইনিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বড় দুর্বলতা আছে। এছাড়া পোস্ট প্রোডাকশন এর ক্ষেত্রে বিশেষ করে কালার গ্রেডিংয়ের ক্ষেত্রেও আমাদের একটা বড় দুর্বলতা আছে। সব মিলিয়ে আমাদের এই জায়গাগুলোতকে উন্নতি করতে হবে।
দৈনিক আনন্দবাজার: এক্ষেত্রে সরকারের কী কোনও দায় ছিলো না?
জুবায়ের বাবু: আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিটা কখনোই ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দাঁড়ায়নি। সরকার থেকে যেভাবে সহযোগিতা করার কথা সেটা করা হয়নি। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোডাকশন কোম্পানিগুলো করপোরেট কোম্পানি হিসেবে দাঁড়ায়নি। এগুলো ব্যক্তি কেন্দ্রীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক প্রোডিউসার ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা করেন। এখন তার অনেক টাকা পয়সা হয়েছে। চিন্তা করলেন একটা ছবি প্রোডিউসিং করি। কিন্তু তিনি প্রফেসনাল ইনভেস্টর না। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রফেসনাল ইনভেস্টর তৈরি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত অন্য সেক্টরগুলোতে প্রফেশনালিজম দাঁড়ানোটা খুব কঠিন।
দৈনিক আনন্দবাজার: প্রথম ছবি কোনটি হবে এবং সেখানে কী কী থাকছে?
জুবায়ের বাবু: আমি দুটি গল্প নিয়ে কাজ করছি। গল্পটা নাই বললাম। আমি বাংলাদেশের গল্প বলতে চাই। নিজের বা নিজের দেশের গল্প যদি আপনি না বলতে পারেন, অন্যের গল্প ধার করতে আপনি দাঁড়াতে পারবেন না। আপনি নিজের ভাষা না শিখতে পারলে অন্যের ভাষা কীভাবে শিখবেন? চলচ্চিত্রও একটি ভাষা। এই ভাষাটিতে আপনি আপনার বা আপনার দেশের গল্প যদি না বলতে পারেন সেখানে অন্যের দেশের গল্প তুলে ধরে আপনি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন না। আমি বাংলাদেশের গল্প বলবো এবং সেই গল্পগুলো আমাদের সমসাময়িক বিষয়গুলো টাচ করবে, এটার আমি নিশ্চিয়তা দিতে পারি। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে আমি অবশ্যই কমার্সিয়াল বিষয়টি মাথায় রাখবো। এই চলচ্চিত্রগুলো বানানোর পরে শুধু পুরস্কার পাবে কিন্তু দর্শক দেখবে না, এই ধরণের চলচ্চিত্র নির্মাণে আমি আগ্রহী না। আমি যত বেশি দর্শকের কাছে যেতে পারবো আমি নিজেকে ততো সফল দাবি করতে পারবো।
দৈনিক আনন্দবাজার: আপনি এই চলচ্চিত্রগুলো কেন তৈরি করবেন?
জুবায়ের বাবু: দেখুন বাংলাদেশের ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিগুলো একটা সময় অনেক দুর্দান্ত ছবি তৈরি করেছে। এখানে অনেক বিজ্ঞ মানুষগুলো কাজ করেছে। পরবর্তীতে এই ইন্ডাস্ট্রিটাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠির কথাই বলবো তারা হয়তো পরিকল্পনা করেই এটা করেছে। এখন ঘটনা হচ্ছে- চলচ্চিত্র হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যেটা আপনার সংস্কৃতি বা কালচালরকে তুলে ধরা হয়। আবার চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবেও ধরা হয়। আমাদেরকে চলচ্চিত্র বর্তমানে যে অবস্থানে আছে সেই জায়গাটা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে আন্তর্জাতিক জায়গায় পৌছাতে হবে। এটা যেন একটি ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়ায় সেই কাজটি করতে হবে। ঠিক ইরানী ছবির মতো যাতে বাংলা ছবিও একটি ব্যান্ড হয়ে দাঁড়ায় সেই জন্য আমি কাজ করবো। আমি দেশের সবাইকে সাথে নিয়ে এই কাজটি করতে চাই।
দৈনিক আনন্দবাজার: দেশে কী আসলে স্থায়ীভাবেব থাকবেন নাকি আবার চলে আসবেন?
জুবায়ের বাবু: এখন আসলে কাজ কর্মের জন্য থাকা হচ্ছে ইংল্যান্ডে। তাছাড়া বাচ্চারা বড় হচ্ছে এখানে। তাদের পড়াশোনা এখানে। কিন্তু আমার মনটা আসলে পড়ে থাকে দেশে। সে হিসেবে আমাকে আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকতে হবে। কিন্তু আমি চাচ্ছি বাংলাদেশে একটা ব্যাপক সময় কাটাবো। কারণ এই বাংলাদেশই আমাকে তৈরি করেছে। আমি মনে করি আমার এখন যেই সময়টা সেটা দেশকে পরিশোধ করার সময়। আমি এই বয়সটাতে এসে দেশকে আমার ঋণ পরিশোধ করতে চাই। আমি যতটুকু পারি আমি দেশকে দেওয়ার চেষ্টা করবো।