বিশ্ব অর্থনীতিতে চলমান সংকটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে বৈদেশিক আয় তথা রেমিট্যান্স রাখছে শুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যার সিংহভাগ আসছে মধ্যপ্রাচ্যর দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও ওমান থেকে। বৈধ চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহ দিতে সরকার ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদানসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও প্রধান বাধা হয়ে রয়েছে হুন্ডি চক্র।
বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো হুন্ডি চক্রের বিরুদ্ধে দফায় দফায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সতর্কবার্তা দিলেও কার্যত তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এতে সরকার বৃহৎ রেমিট্যান্স রিজার্ভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার সাধারণ প্রবাসীরা রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা অসঙ্গতির বিষয়েও অভিযোগ রয়েছে। তাদের অভিযোগ, পাসপোর্ট অফিসগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম্য, বিমানবন্দরে হয়রানি বন্ধসহ দূতাবাসের সেবার মান বাড়লে দেশে রেমিট্যান্স আগের চেয়ে আরও বাড়বে।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব আয়োজিত ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে প্রবাসীদের ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেছেন বক্তারা। দেশের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রবাসী বাংলাদেশি সিআইপি মাহতাবুর রহমান নাসির ওই বৈঠকে বলেন, দেশের নানা সংকটে প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাদের অনেক দাবির মধ্যে অন্যতম রেমিট্যান্স প্রণোদনার পরিমাণ ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে যেন ৪ শতাংশ করা হয়।
মাহতাবুর রহমান আরও বলেন, যেখানে সরকার পণ্য রপ্তানি, কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে শিল্পখাতে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দিচ্ছে। অথচ সেখানে সীমাহীন অনিয়ম দুর্নীতি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈধ অর্থ প্রেরণে ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ প্রণোদনা চাওয়া প্রবাসীদের ক্ষেত্রে দাবিকে যৌক্তিক মনে করছি। যা বাস্তবায়ন করা হলে অচিরেই হুন্ডি বন্ধ করা সম্ভব হবে।
বৈঠকে বক্তারা রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ব জনতা ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিমানের সেবা অন্যান্য সংস্থার সেবার সঙ্গে যে সামঞ্জস্য থাকে সে ব্যাপারে প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া বৈধ মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়াতে ব্যাংক চার্জ মওকুফ, মোবাইল অ্যাপ তৈরি, চলমান রেমিট্যান্স প্রণোদনা ৪ শতাংশে উন্নীতকরণ, বন্ডের লভ্যাংশ বৃদ্ধি করা, বিদেশে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগ নেয়া, কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা প্রদান বিষয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
একই সঙ্গে বিদেশে প্রশিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী প্রেরণ, দেশ থেকে আমদানি করা পণ্য পুনঃরপ্তানির সুযোগ তৈরি করা, হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও জড়িতদের চিহ্নিতকরণ, দেশের বাইরের জনতা ব্যাংকের ঋণ খেলাপিদের ঋণ পরিশোধ, প্রবাসীদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু ও ক্যাপিটাল মার্কেট তৈরির বিষয়ে সুপারিশ প্রস্তাব করেন।
বৈঠকে অংশ নিয়ে দুবাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত সময়োপযোগী উদ্যোগ। এই যে বৈশ্বিক সংকট, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখন যে সংকটে আছে এটাকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই সংকটের প্রভাবে শুধু বাংলাদেশ না, গোটা পৃথিবী এখন শঙ্কিত। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের অ্যানালাইসিস আসছে। তাতে দেখা গেছে, দুটো দেশ অত্যন্ত লাভবান হচ্ছে। তারা হলো- আমেরিকা ও রাশিয়া।
বিএম জামাল হোসেন আরও বলেন, রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার চাবিকাঠি। যা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। রেমিট্যান্স ইনফ্ল নিয়ে কিছু কথা আসছে। আমি বলবো, সমস্যা থাকবেই, সমাধান হয় না বলেই সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যুগের পরিবর্তন হচ্ছে, যুগের সঙ্গে তাল না মেলাতে পারলে ছিটকে পড়তে হবে বলে মনে করেন ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক।
এছাড়াও আলোচনায় কনস্যুলেটের কমার্শিয়াল কাউন্সিল, বিমান বাংলাদেশের দুবাইস্থ রিজিওনাল ম্যানেজার, জনতা ব্যাংক দুবাই ও শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ, প্রবাসী ব্যবসায়ীসহ দেশ থেকে আগত ও প্রবাসী সাংবাদিকরা অংশ গ্রহণ করেন।
আনন্দবাজার/শহক